সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

হত্যাচেষ্টার মামলা কি আপসযোগ্য?

এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে করা মামলার আপসনামা আদালত গ্রহণ করায় অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সিকদার ভ্রাতৃদ্বয়—রন হক ও দিপু হক। আদালতসূত্র উদ্ধৃত করে পত্রিকার খবর বলছে, এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে হত্যাচেষ্টার মামলা তদন্ত করে সম্প্রতি রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই দিপু হক সিকদারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয় পুলিশ। মামলার বাদী এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) সিরাজুল ইসলামের কাছে আদালত জানতে চান, পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন এবং উভয় পক্ষের আপসনামায় কোনো আপত্তি আছে কি না? এতে বাদীর কোনো আপত্তি না থাকায় আদালত পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করেন।

মামলার এজাহারে অভিযোগ ছিল, গত বছরের ৭ মে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে বন্ধকি সম্পত্তি পরিদর্শনের নামে এক্সিম ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে রন হক সিকদার গুলশানে তাঁদের প্রধান কার্যালয় থেকে তুলে নিয়ে যান। এক্সিম ব্যাংকের ওই দুই কর্মকর্তা—এমডি মুহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মুহাম্মদ ফিরোজ হোসনেকে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বন্দী করে রাখেন রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই দিপু সিকদার। তাঁদের গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়। মামলায় আরও বলা হয়, পুরো ঘটনা এ সময় জামানত হিসেবে ওই সম্পত্তির বন্ধকি মূল্য কম উল্লেখ করায় ব্যাংকটির এমডি ও অতিরিক্ত এমডিকে গুলি ও মারধরের ঘটনা ঘটে। রন হক সিকদার ও দিপু হক সিকদার সে সময় ব্যাংকটির এমডির কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে জোর করে সই নেন।

গত ২৬ জুলাই আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলার বাদী ও বিবাদীর ভুল-বোঝাবুঝির কারণে এ মামলার উদ্ভব হয়েছে। পরে বাদী-বিবাদী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে একটি সমঝোতা চুক্তি করেন। নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে আসামিদের অভিযুক্ত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণাদিও পাওয়া যায়নি। সমঝোতায় বাদী-বিবাদী বলেছেন, তদন্তের ফলাফল তাঁরা মেনে নেবেন এবং পরবর্তীকালে তাঁরা এ বিষয়ে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেবেন না।

ঘটনার বিবরণ থেকে অন্তত দুটি তথ্য নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে; ১. আপসরফায় প্রমাণিত হয় কিছু একটা অপরাধ ঘটেছিল এবং ২. অপরাধটি হচ্ছে হত্যাচেষ্টা, যা গুরুতর অপরাধ এবং আইনে এর সম্ভাব্য সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। ফৌজদারি কার্যবিধিতে আপস অনুমোদনের সুযোগ খুবই সীমিত এবং ৩৪৫ ধারায় যেসব অপরাধের তালিকা দেওয়া আছে, তার বাইরে কোনো অভিযোগে আপস-রফা গ্রহণের সুযোগ নেই। ওই তালিকায় হত্যাচেষ্টার কথা নেই। বেআইনিভাবে আটক রাখার অংশটুকুকে ভুল-বোঝাবুঝি হিসেবে চালিয়ে দেওয়া গেলেও হত্যাচেষ্টা কীভাবে আড়াল করা যাবে?

মামলার অভিযোগ যে গুরুতর ছিল, তার ধারণা মেলে ভ্রাতৃদ্বয়ের সরকারি নিষেধাজ্ঞার মধ্যে গোপনে দেশত্যাগ, দেশের বাইরে থেকে আগাম জামিনের চেষ্টার ঘটনাগুলোয়। বাদী এক্সিম ব্যাংকের পরিচালক সিরাজুল ইসলাম ১০ আগস্ট প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছিলেন, আসামি সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই দিপু হক সিকদার নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ায় সমঝোতা হয়েছে। তবে রন হক সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ক্ষমা চেয়েছি, বিষয়টা সত্য নয়। আমাদের আপসনামায় সব উল্লেখ আছে। পুলিশ রিপোর্টে যা বলা, সে বিষয়ে বাদী তাঁর আপত্তি নেই বলে আদালতে উপস্থিত হয়ে জানিয়েছেন।’ স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, আপসনামার পেছনে আসলে কী কাজ করেছে? ক্ষমতা?

সমকাল জানিয়েছে, এ মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ছিলেন পরীমনি-কাণ্ডে আলোচিত ডিবি থেকে সদ্য বদলি হওয়া অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলায়েন। তাঁর নৈতিকতার উঁচু মান নিয়ে কথা কি বন্ধ করা যাবে?

সিকদার পরিবারের বেলায় আইন প্রয়োগে শৈথিল্য নতুন কিছু নয়। না হলে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদে একই পরিবারের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বছরের পর বছর ব্যতিক্রম সম্ভব ছিল না।

তাঁরা ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে গড়ে তুলেছেন চার তারকা হোটেল । তাঁদের মালিকানায় আছে যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস, নিউইয়র্ক, প্রমোদ নগরী হিসেবে খ্যাত লাসভেগাস, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবি ও থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অভিজাত রেস্টুরেন্ট। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডেও রয়েছে একাধিক কোম্পানি ও বিপুল বিনিয়োগ।

সিকদার পরিবারের এই বিশেষ সুবিধাগুলো আইনের শাসন বিষয়ে জনমনে কী ধারণার জন্ম দেবে, সে প্রশ্ন কি আর উপেক্ষা করা চলে?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...