বাংলাদেশ এবং ফোন হ্যাকিং বা আড়িপাতার প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম আবারও সংবাদ শিরোনামে ফিরে এসেছে। ইসরায়েলি দৈনিক হারেৎজের খবরে বলা হয়েছে, আড়িপাতা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সেলব্রাইট মানবাধিকার লংঘন এবং তথ্য সুরক্ষার বিষয়ে উদ্বেগের কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে তাদের সরঞ্জাম বিক্রি বন্ধ করার কথা জানিয়েছে। ইসরায়েলের আরেকটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসও’র ফোনে আড়িপাতা প্রযুক্তির বেআইনি ব্যবহার নিয়ে যখন বিশ্ব জুড়ে তোলপাড় চলছে, তার মধ্যেই এই খবরটি প্রকাশ পেল।
সেলব্রাইট যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য দেশটির সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) কাছে কোম্পানির ব্যবসায়িক নীতি-নৈতিকতার ঘোষণা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা পূরণে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে তারা বলেছে, মানবাধিকার লংঘনের বিষয়ে উদ্বেগের কারণেই তারা বাংলাদেশের কাছে ফোনে আড়িপাতার সরঞ্জাম বিক্রি করবে না। হারেৎজের প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের র্যাবের নামও এসেছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বেলারুশ ও হংকংয়ের মতো কয়েকটি দেশের কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছে, সেলব্রাইটের এক মুখপাত্র বুধবার তাদের বলেছেন যে রাশিয়া ও বাংলাদেশসহ কিছু দেশে পণ্য বিক্রি বন্ধের দাবিতে ইসরায়েলি আদালতে মামলা এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনের কারণে প্রতিষ্ঠানটির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়ে থাকতে পারে। সেলব্রাইট আরও বলেছে, ‘গ্রাহকেরা আমাদের পণ্যের অপব্যবহার করেছে—এমন অভিযোগ ভবিষ্যতেও আমাদের সুনাম ক্ষুন্ন করতে পারে, এমনকি যদি আমরা সেই অপব্যবহারের কোনোরকম অংশীদার না-ও হই বা তাদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে দ্রুত পদক্ষেপ নেই’।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ইসরায়েলের কাছ থেকে এমন কিছু আমদানিই করা হয়নি। তিনি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে তো আমাদের এমন কোনো সম্পর্ক নেই যে তাদের কাছ থেকে আমরা আড়িপাতার যন্ত্র আমদানি করবো’। তিনি অবশ্য বলেছেন, ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের’(এআই) যন্ত্রপাতি আমরা বিভিন্ন দেশ থেকে সংগ্রহ করি৷’ সেলব্রাইটের তৈরি নজরদারি প্রযুক্তি র্যাব ব্যবহার করে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘র্যাব যা ব্যবহার করে, তা আমরা ওদের (ইসরায়েল) কাছ থেকে কোনোদিনই আমদানি করিনি’।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যন্ত্রপাতি বলতে কী বোঝালেন, তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। তবে আমরা জানি কম্পিউটিং বা ডিজিটাল প্রযুক্তির পুরোটাই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ওপর নির্ভরশীল। সুতরাং তাঁর ভাষা প্রয়োগের চাতুর্যে আমরা মুগ্ধ হতে পারি, কিন্তু আশ্বস্ত হতে পারি না যে আড়িপাতা প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে না। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও যে দেশটির পণ্যের আমদানি সম্ভব না, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।
অভিযোগ হচ্ছে, সিঙ্গাপুর ও হাঙ্গেরির মতো তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আমরা এসব সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি কিনছি। আল-জাজিরার অনুসন্ধানে দাবি করা হয়েছে, মুঠোফোনে আড়ি পাতার প্রযুক্তি বাংলাদেশ কিনেছে এবং তা হাঙ্গেরি থেকে কেনা হলেও মূলত ইসরায়েলের পিকসিক্স কোম্পানির প্রযুক্তিপণ্য।
২০১৯ সালে কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস স্টাডিজ ‘দ্য গ্লোবাল এক্সপ্যানসন অব এআই সার্ভেইলেন্স’ প্রকাশ করেছিল। তাতে বৈশ্বিক এআই নজরদারি সূচকও দেওয়া হয়েছে। ওই সূচকে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশে নজরদারির সব প্রযুক্তিই ব্যবহার হচ্ছে।
ফোনে আড়িপাতার সরঞ্জাম নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ হয়ে উঠেছে এই প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে। সাংবাদিকদের যৌথ উদ্যোগ ফরবিডেন স্টোরিজ এবং মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক যৌথ অনুসন্ধানে প্রমাণ মিলেছে যে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসওর তৈরি ফোনে আড়িপাতার প্রযুক্তি পেগাসাসের অপব্যবহার অবিশ্বাস্য মাত্রায় পৌঁছেছে। প্রথমত: এই প্রযুক্তি কর্তৃত্ববাদি সরকারগুলোর পছন্দের হাতিয়ার হয়ে উঠছে এবং দ্বিতীয়ত: আড়িপাতার শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিক ও সাংবাদিকেরা। শুধু ভিন্নমতাবলম্বীই নয়, অনুসন্ধানে এমন অকল্পনীয় তথ্যও বেরিয়ে এসেছে যে মরক্কোয় নিরাপত্তাবাহিনী দেশটির রাজা ও প্রধানমন্ত্রীর ফোনেও আড়ি পেতেছিল। আরও যেসব রাষ্ট্রনেতার নাম এসেছে তাঁদের মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাঁখো, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও আছেন। পেগাসাসের এই অপব্যবহারের খবর রাজনৈতিকভাবে এতটাই স্পর্শকাতর যে ইসরায়েল সরকারও এনএসওর কার্যক্রম তদন্তের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছে।
পেগাসাস অপব্যবহারের ব্যাপকতা সম্ভবত সবচেয়ে অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে। সেখানে শীর্ষস্থানীয় সম্পাদক ও সাংবাদিক, ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবি, বিরোধী রাজনীতিক, এমনকি সরকারের প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রীর ফোনেও আড়িপাতার কথা জানা গেছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নির্বাচনে অন্যায় সুযোগ গ্রহণের জন্য এই পেগাসাসের অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। ভারতের এডিটর্স গিল্ড, কয়েকজন সাংবাদিক এবং একজন কংগ্রেস নেতা আদালতের আশ্রয় নিলে সুপ্রিম কোর্ট মামলার শুনানি গ্রহণ করেছেন। অভিযোগ সত্য হলে তা নিঃসন্দেহে গুরুতর মন্তব্য করে শুনানির শুরুর দিনে প্রধান বিচারপতি এন ভি রমনা বলেছেন, ‘সত্য কী, তা জানা প্রয়োজন। আমরা এখনো জানি না কার কার নাম আছে।’ সরকারের জবাবের জন্য শুনানি আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত মুলতবি আছে। ভারতের আদালত এই মামলায় কী সিদ্ধান্তে পৌঁছায় তার প্রতি এখন অনেকেরই দৃষ্টি।
পেগাসাস ও সেলব্রাইটের ‘ইউনিভার্সাল ফরেনসিক এক্সট্রাকশান ডিভাইস’ দুটোই মুঠোফোনে আড়িপাতার কাজে ব্যবহার করা হয়। এসব প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণার জন্য পরিচিত কানাডার ডিজিটাল ল্যাবের একাধিক প্রকাশনা থেকে জানা যায়, ব্যবহারকারীর অগোচরে তাঁর স্মার্টফোনে পেগাসাস প্রবেশ করতে পারে। এর মাধ্যমে ফোনে যাবতীয় তথ্য নজরদারীর আওতায় চলে আসে।
সেলব্রাইটের ইউনিভার্সাল ফরেনসিক এক্সট্রাকশান ডিভাইসও দূর থেকে অন্য ফোনের তথ্য হাতিয়ে নিতে সক্ষম। নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা এর সাহায্যে তাঁদের নজরদারিতে থাকা ব্যক্তিদের গতিবিধি জানতে পারে। তাদের ফোন থেকেও সব তথ্য পেয়ে যায়। সেলব্রাইটের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, এই প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ব্যবহার করে মোবাইল ছাড়াও অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসে বিশেষভাবে পাসওর্য়াড দিয়ে সংরক্ষিত বা এনক্রিপ্টেড ফাইল থেকেও তথ্য বের করার কাজটি সম্ভব হয়।
সন্ত্রাস ও গুরুতর অপরাধ দমনের জন্য এসব প্রযুক্তি ব্যবহার প্রয়োজন বলে নিরাপত্তাবাহিনীগুলো দাবি করে থাকে। সরকারও তাদের দাবি পূরণে বরাদ্দ দিতে কার্পণ্য করে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এক্ষেত্রে যেমন নাগরিকদের প্রয়োজনীয় আইনগত সুরক্ষার ব্যবস্থা নেই, তেমনি নেই বেআইনি ব্যবহার বা অপব্যবাহার রোধে উপযুক্ত তদারকি ব্যবস্থা। নাগরিকদের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার অধিকার সংবিধান প্রদত্ত। অথচ, নিরাপত্তার অজুহাতে তার প্রয়োগ হচ্ছে প্রয়োগকারীর স্বেচ্ছাচারমূলক। এই প্রয়োগকারী কখনও ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিবিদ, কখনও নিরাপত্তাবাহিনীর কর্তাব্যাক্তিরা। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীনেত্রীর টেলি-সংলাপ ফাঁস হওয়ার পর থেকে কোনো পেশার মানুষই রেহাই পাননি। যাঁদের আলাপ ফাঁস হয়েছে লক্ষ্যণীয়ভাবে তাঁরা সবাই সরকারবিরোধী অথবা সরকারের কারও রোষানলের শিকার। কার্যকর গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন ছাড়া এই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধের কোনো বিকল্প নেই। সেলব্রাইট জানিয়েছে, তাদের সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক মানবাধিকার আন্দোলনের ফল। এই প্রযুক্তির উন্নয়নে অন্য যারা কাজ করছেন তারাও সেলব্রাইটের পথ অনুসরণ করলে অবশ্য কিছুটা সুফল মিলতেও পারে।
(২০ আগস্ট, ২০২১-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন