অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।এঁরা এখন বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের
মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। ফলে অন্য দেশের
আশ্রিত এসব উদ্বাস্তু রোহিঙ্গার অবস্থান যত দীর্ঘায়িত
হবে, আমাদের ওপর চাপও তত বাড়বে।সুতরাং, স্বাগতিক জনগোষ্ঠীর ধৈর্যচ্যূতির আশংকা নাকচকরে দেওয়া যায় না।এসব উদ্বাস্তুদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ ও
চেষ্টাকে ত্বরান্বিত করা তাই অগ্রাধিকারের তালিকায়
থাকাই স্বাভাবিক।তবে গত চার বছরে কূটনৈতিক
পথে সেই উদ্যোগে কোনো অগ্রগতি নেই
উপরন্তু, গতবছর মিয়ানমারে যে সামরিকবাহিনীর
আবারও ক্ষমতা দখলের কারণে কূটনৈতিক প্রক্রিয়াও
পুরোপুরি থমকে গেছে। সেখানকার সামরিক সরকার
নির্বাচনকে নাকচ করে দিয়ে গণতন্ত্রপন্থীদের বিরুদ্ধে যে নিষ্ঠুর দমনপীড়ন চালাচ্ছে তার কারণে আর্ন্তজাতিক
সম্প্রদায়ের অগ্রাধিকারও কিছুটা বদলে গেছে বলে মনে হয়। তাঁদের কাছে এখন দেশটির গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারই
বেশি গুরুত্বর্পূণ।
সর্বসাম্প্রতিক সামরিক শাসনজনিত সংকটের প্রাক্কালে কি কূটনৈতিকভাবে আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে কোনো অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছিলাম? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবেই হতাশাজনকএক্ষেত্রে আমাদের
এশীয় মিত্র এবং প্রতিবেশিদের সমর্থন আদায়ে ব্যর্থতাই
সবচেয়ে পীড়াদায়ক। এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদে
বিভাজন খুবই স্পষ্ট এবং তা সহসা দূর হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সাধারণ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ
মিয়ানমারের জাতিগত বৈষম্য ও নিপীড়ন বন্ধ এবং
শরণার্থী প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একাধিকবার প্রস্তাব গ্রহণ করলেও আমাদের প্রতিবেশীদের অধিকাংশই হয় ভোটদানে বিরত থেকেছে, নয়তো বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।প্রতিবেশীদের সহানুভূতি ও সমর্থনের এই ঘাটতি
আঞ্চলিক পরিসরে কোনো সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের
সম্ভাবনাকেও নাকচ করে দিয়েছে। আমাদের নিজেদের
নীতিতেও যে ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটেছে, সে কথাও ভুলে যাওয়ার নয়।মিয়ানমারে নির্বাচনের ফলাফলকে বাতিল করে দিয়ে সেনাশাসন জারির নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ গত ১৮ জুন যে প্রস্তাব গ্রহণ করে, আমরা সেই প্রস্তাবেও ভোট দেইনি।প্রস্তাবটিতে ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের
বিষয়ে পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে
স্বীকৃত হয়নি’ বলে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকার
এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।মিয়ানমারের সেনাবাহিনী
বাংলাদেশের এই ভূমিকায় কতটা তুষ্ট হয়েছে, তা আমরা জানি না। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে
যে সেখানকার সেনাশাসকের মনোভাব যে একটুও
বদলায়নি, তা তাঁর কথা ও কাজে প্রমাণিত হয়েছে।মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও বিতাড়নের জন্য
আমাদের সরকার অবশ্য তখনকার বেসামরিক নেতৃত্ব অর্থাৎ শুধুমাত্র অং সান সূচিকেই এককভাবে দায়ী করে থাকলে অন্য কথা। সেরকম কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ সরকার
পেয়ে থাকলে তো এতোদিনে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসিতে বাংলাদেশের মামলা করা কিম্বা আইসিসির তদন্তকারীদের কাছে তা হস্তান্তরের কথা।সেরকম কিছু তো হয়নি।রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারে
আমাদের যতটা উদ্যোগী ও সাহসী হওয়ার কথা ছিল,
ততটা আমরা হতে পারিনি।
কূটনৈতিক এসব ব্যর্থতা অথবা অক্ষমতা আড়াল করার একটি সহজ উপায় হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের
প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি না হওয়ার দায়
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া।
মন্ত্রী, রাজনীতিক ও কূটনীতিকরা আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায়ে ঠিক কাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, আর কাদের বাদ দেন, তা মোটেও স্পষ্ট নয়। কিছুদিন আগে তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতিতে তাঁরা বললেন আন্তর্জাতিক
সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের আত্তীকরণ বা স্থায়ীভাবে রেখে
দেওয়ার কথা বলছে। বিশ্বব্যাংক রোহিঙ্গাদের জন্য
আলাদা ৫৯ কোটি ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তাঁদের কথা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাংক জাতিসংঘ শরণার্থী
সংস্থা, ইউএনএইচসিআরের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক (আরপিআরএফ) তৈরি করেছে, তাতে এই প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক যে আরপিআরএফ তৈরি করেছে, সেটা সত্য।বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ৫৯ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেছে, তাতেও কোনো ভুল নেই। তবে, সমস্যা হচ্ছে এগুলো সবই খন্ডিত তথ্য।আরপিআরএফ শুধু যে রোহিঙ্গাদের বা বাংলাদেশের
জন্য আলাদা কিছু, মোটেও তা নয়। বিশ্বে বর্তমানে যে
আড়াই কোটিরও বেশি শরণার্থী আছেন, তাঁদের আশি
শতাংশেরও বেশি আশ্রয় পেয়েছে উন্নয়নশীল
দেশগুলোতে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে যারা
উন্নয়ন সহায়তা পেয়ে থাকে এরকম ডজনখানেক
দেশের জন্য বিশ্বব্যাংক এই আরপিআরএফ তৈরি
করেছে। সুতরাং, এটি শুধু ‘বাংলাদেশকে নিয়ে
ষড়যন্ত্র’ জাতীয় কিছু নয়।
বাংলাদেশের জন্য ৫৯ কোটি ডলারের বরাদ্দ প্রস্তাব
সঠিক হলেও তার সম্ভাব্য উপকারভোগী শুধু রোহিঙ্গা
শরণার্থীরা নন, তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনপদ ও
জনগোষ্ঠীও এর আওতায় আসবে।বিশ্বব্যাংকের ওই সমীক্ষায় স্পষ্ট করে তিনমাত্রার
লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছেঃ ১.শরণার্থী প্রবাহের কারণে যে হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিপর্যয় কাটাতে স্বাগতিক
জনগোষ্ঠী ও শরণার্থীদের জন্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির সুযোগ তৈরি করা; ২. শরণার্থী পরিস্থিতি
দীর্ঘায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাগতিক দেশে শরণার্থীদের
টেকসই আর্থসামাজিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে অথবা
তাদের নিজ দেশে ফেরানোর মাধ্যমে টেকসই সমাধানকে ত্বরান্বিত করা; এবং ৩. সম্ভাব্য নতুন শরণার্থী প্রবাহ বা নতুন শরণার্থী আসার সম্ভাবনা মোকাবিলায় দেশের
প্রস্তুতি জোরদার করা।
বিশ্বব্যাংকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় লক্ষ্য নিয়েই মূল বিতর্ক।আপাতদৃশ্যে মনে হয় তারা শরণার্থীদের স্থায়ীভাবে
আত্তীকরণের কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে,
শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোয় আমাদের যে রেকর্ড তা
বিবেচনায় নিলে বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবে বিস্মিত হওয়ার
কিছু নেই। আমরা ৯০র দশকে আসা রোহিঙ্গাদের
তিন দশকেও ফেরত পাঠাতে পারিনি।আবার, ২০১৬তে
নতুন কিছু শরণার্থী আসার পরও বুঝতে পারিনি যে
২০১৭ সালে নতুন করে কয়েকগুণ বড়
আকারে শরণার্থী আসতে পারে। সেজন্যে আগে থেকে
কূটনৈতিক কার্যক্রমও যেমন ছিল না, তেমনি আশ্রয়
দেওয়ার প্রস্তুতিও ছিল না।বিশ্বব্যাংক শরণার্থীদের
ফেরত পাঠানোর কথা বলার পাশাপাশি তা না
হলে মানবিকভাবে সমস্যাটি মোকাবিলার কৌশল প্রস্তাব করেছে।সবচেয়ে বড় কথা, স্বাগতিক জনপদ
ও সেখানকার স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর যে চাপ তৈরি
হয়েছে তা প্রশমনে তাদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা দেওয়া
জরুরি। ওই প্রস্তাবে সে বিষয়েও সমগুরুত্ব দেওয়া
হয়েছে।অথচ, প্রস্তাবটিকে শুধু শরণার্থীদের কল্যাণের
পরিকল্পনা হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতাই বিশেষভাবে
দৃশ্যমান হয়।
বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু, প্রস্তাবটি নিয়ে রাজনীতি করা দূর্ভাগ্যজনক।এর পরিনতিতে রোহিঙ্গাবিদ্বেষ উসকে দেওয়ার মত
ঘটনাও দৃশ্যমান হচ্ছে। যেসব বুদ্ধিজীবি রোহিঙ্গাদের
রাজনৈতিক প্রতিবাদ সংগঠিত করতে দিতেও রাজি না, সংগঠিত হওয়ার আলামত দেখলেই জঙ্গিবাদের প্রভাব দেখেন, তাঁরাই এখন বলছেন ওরা তো নিজেদের দেশে ফেরার সংগ্রাম করছে না। মিয়ানমারের অন্যান্য
জাতিগত গেরিলা গোষ্ঠীর লড়াইয়ের নজির তুলে ধরে
এধরণের প্রশ্ন তোলা কতটা যৌক্তিক এবং নৈতিক?
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এসব রোহিঙ্গাদের শিক্ষা,
কাজ করার বা ছোট আকারে ব্যবসা করার সুযোগ,
আইনগত সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারের মত মৌলিক
মানবাধিকারগুলো নিশ্চিত করার কথাও ওই প্রস্তাবে
আছে। এগুলো আমাদের কাছে অচেনা-অজানা
মনে হতে পারে।কিন্তু এগুলোর সবই শরণার্থীদের
অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদে সুনির্দিষ্টভাবে
উল্লেখ করে নিশ্চিত করার কথা বলা হযেছে।বাংলাদেশ শরণার্থী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ না হওয়ায়
এগুলো মানতে বাধ্য নয় বলে দাবি করে থাকে।এই দাবি
সত্য হলেও তা মানবিক নয়, এবং সনদে সাক্ষরকারী
ছাড়াও এধরণের সুবিধা দেওয়ার নজির আছে।ভারতও শরণার্থী সনদে স্বাক্ষর করেনি, কিন্তু
বাংলাদেশের বহু বুদ্ধিজীবিকে ৭১ সালের উদ্বাস্তুজীবনে চাকরি করতে দিয়েছে। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা শিবির
কিম্বা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে এতো বিপুলসংখ্যক
শরণার্থী কিশোর-তরুণ শিক্ষার সুযোগ না পেলে
এবং কর্মক্ষম নরনারী কাজ করতে না পারলে বছরের
পর বছর অলস জীবনযাপন করবে - এমন ভাবনা
বিভ্রান্তিকর। ভাসানচরে ইতোমধ্যে মাছ ধরার
জাল এবং গরু লালনপালনের ব্যবস্থা যেটুকু করা হয়েছে, তা যদি সঠিক হয়, তাহলে কক্সবাজারের
রোহিঙ্গারা একইধরনের সুযোগ পাবে না কেন? এখানে নীতির
ধারাবাহিকতা থাকা দরকার এবং তাতে বাড়তি লাভ
হচ্ছে বিদেশি সহায়তা বাড়তে পারে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মৌলিক অধিকারের প্রসঙ্গে
সবচেয়ে দূর্ভাগ্যজনক খবরটি সোশাল মিডিয়ায় এসেছে দুদিন আগে। সেখানকার তরুণদের অনেকেই
অভিযোগ করেছেন আজ তাঁরা গণহত্যা স্মরণ দিবস
পালনের জন্য গণহত্যার বিচারের দাবি লেখা গেঞ্জি
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বাজেয়াপ্ত করেছে। গণহত্যায়
নিহতদের স্মরণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার দাবি করার অধিকার শরণার্থীদের থাকবে না,এটা কেমন সিদ্ধান্ত।গণহত্যার মর্মবেদনা বাঙালির চেয়ে কে বেশি
অনুভব করে? অথচ, সেই বাঙালির দেশে আশ্রয়প্রাপ্তরা অন্য আরেকটি দেশে গণহত্যার শিকার বাবা-মা, ভাই-বোনদের স্মরণ করতে পারবে না? আশা করি, আজ সকালেই ওই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।
(২৫ আগস্ট, ২০২১ এর প্রথম আলো পত্রিকায়
প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন