সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব নয়, প্রেস কাউন্সিল বদলান

দেশের একটি বড় অংশ যখন মারাত্মক বন্যার দূর্যোগে পীড়িত এবং সবার নজর দূর্গতদের উদ্ধার, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে, ঠিক তখনই হঠাৎ সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য আইন সংশোধনকে মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম অবশ্য গত সপ্তাহে বলেছিলে, মন্ত্রিসভার পরবর্তী সভায় আইনটি অনুমোদিত হবে। তখন তিনি আরো বলেছিলেন, আইনে সাংবাদিকেরা অন্যায় করলে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান থাকছে। তাঁর এই বক্তব্যের পরদিন তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেছেন নতুন আইন হছে না। তবে তারও আগে ১০ এপ্রিল (ডেইলি স্টার) তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার ক্ষমতা পাচ্ছে প্রেস কাউন্সিল। বর্তমান প্রেস কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী এ সংশোধনের উদ্যোগ শুধু সমর্থন করেছেন তা-ই নয়, তিনি জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে কাউন্সিলের আগের কমিটিগুলোতেও আলোচনা হয়েছে। একসময়ের ইউনিয়ন নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী বর্তমানে,দ্য ডেইলি অবজারভার পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদক এবং টিভি চ্যানেল ডিবিসি নিউজের মালিক। তিনি আগেও প্রেস কাউন্সিলে ছিলেন। 


বর্তমান কাউন্সিলের অন্য সদস্যদের চারজন অবশ্য ডেইলি স্টার পত্রিকাকে জানিয়েছেন কাউন্সিলে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, প্রস্তাবও নেওয়া হয়নি।  ডেইলি স্টার কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের কাছে কাউন্সিলের সাংবাদিক ও সম্পাদক প্রতিনিধিরা এবিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, `আমি বলব, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল সম্মতি দিয়েছে। সদস্যদের কেউ সম্মতি দেয়নি এমন রেকর্ড নেই।` স্পষ্টতই বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে তারপরও যেটুকু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যায়, সাংবাদিকদের দন্ড প্রদানসহ প্রেস কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টি হঠাৎ কিছু নয়, বরং পরিকল্পিত এবং পরিকল্পনাটি অনেকদিনের। সরকার সমর্থক সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশকদের মধ্যে নেতৃস্থানীয়রা এই উদোগের সক্রিয় অংশীজন এবং তাঁরা নিশ্চিতভাবে আস্থা রাখেন যে কাউন্সিলের বাকি সদস্যরাও তাঁদের সঙ্গে একমত পোষণ করবেন। 


কয়েকদিন আগে ঢাকায় এক আলোচনায় তরুণ অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজের কাছে শোনা একটি বক্তব্য আমার কানে বাজছে। কথাট ছিল এরকম - সুশাসন বা জবাবদিহিতা যাই বলা হোক না কেন, তার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক কবজাকরণ। ফলে, কোনো প্রতিষ্ঠানই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না এবং গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থই সবজায়গায় প্রাধান্য পাচ্ছে। মাশরুরের কথাটা প্রেস কাউন্সিলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যে কাউন্সিলে তার প্রয়াত পিতা রিয়াজউদ্দিন আহমেদ ভিন্নমতের প্রতিনিধিত্ব করতেন। 


কাউন্সিল গঠনের যে আইন, তাতে সংবাদপত্রের সব মত ও ভাবাদর্শের প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা রাখতে সাংবাদিক ইউনিয়ন, সম্পাদকদের সংগঠন এবং মালিকদের সমিতির মনোনীত প্রতিনিধিদের সদস্য করার বিধান রয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, ইউনিয়ন রাজনৈতিক ধারায় বিভাজিত হওয়ায় যে অংশটি সরকার সমর্থক নয়, কাউন্সিলে তাদের কোনো প্রতিনিধির জায়গা হয় নি। আর গত এক দশকে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠ ও অনুগত ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকদের যে হারে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের (যদিও টিভি চ্যানেল  প্রেস কাউন্সিলের এখতিয়ারভুক্ত নয়) অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাতে অন্যান্য শ্রেণি বিচারে ভিন্নমতের কারও সেখানে স্থান পাওয়া হবে ব্যাতিক্রম, নিয়ম নয়। মোদ্দাকথা, আমাদের বর্তমান প্রেস কাউন্সিলে গণতন্ত্রের কোনো প্রতিফলন ঘটার কোনো অবকাশ নেই। কাউন্সিলের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব তাই গণতান্ত্রিকভাবে অনুমোদিত হবে, এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন।


প্রেস কাউন্সিলের বাড়তি ক্ষমতায়নের উদ্যোগ ও প্রস্তাবিত সংশোধনী নিয়ে  অনেকেই ইতিমধ্যে বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আইনগত প্রশ্নও উঠেছে। আইনটির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এমনিতেই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে শারীরিক নিগ্রহ ও হত্যার বিচারহীনতা যখন নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত নিবর্তনমূলক আইন সীমাহীন হয়রানির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তখন মানতেই হবে দেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হচ্ছে সাংবাদিকতা। প্রেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার ৭৪ সালের আদি আইনে লক্ষ্য ও কাজের বিবরণের শুরুতেই বলা আছে, কাউন্সিল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংরক্ষণ ও সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মান উন্নয়নে কাজ করবে। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদেও যেসব  কাজের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হবে প্রথম লক্ষ্যটিকে আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার জন্য। আইনটির বিধান অনুযায়ী সুপিম কোর্টের সাবেক বিচারপতিরাই কাউন্সিলের প্রধান হন। প্রকাশিত খবরের জন্য সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে কেউ কাউন্সিলের শরণাপন্ন হয়ে বিচার চাইলে তার সালিস ছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সুরক্ষায় তাঁরা আজ পর্যন্ত আর কোনো ভূমিকা নিয়েছে বলে শুনিনি। তাঁদের ওয়েবসাইটে যে কয়টি বার্ষিক প্রতিবেদন রয়েছে, তাতেও উল্লেখ করার মত কিছু নেই। 


সাংবাদিকতার নীতিমালায় সেই ৭৪ সালের আইনে যা ছিল, তার কোনো পরিবর্তন গত ৪৮ বছরে হয়নি। অথচ সাংবাদিকতা এখন নতুন প্রযুক্তির বদৌলতে অনেকটাই বদলে গেছে। নীতিমালা হালনাগাদ করার প্রয়োজনীয়তা থেকে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তার প্রক্রিয়াটি হওয়ার কথা গণতান্ত্রিক ও ব্যপকভাবে অংশগ্রহণমূলক এবং তা হতে হবে অবশ্যই মুক্তচিন্তার সহায়ক, প্রতিবন্ধক নয়। প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়াটি নিয়ে যে স্বচ্ছ্বতার নীতি অনুসৃত হয়নি, সে কথা জোর দিয়েই বলা যায়। কাউন্সিলের সদস্যদের কয়েকজন বলেছেন, এটি নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, তাঁরা সম্মতিও দেন নি। আর সাধারণ সাংবাদিকদের মধ্যে তা বিতরণ করে মতামতও চাওয়া হয়নি। এমনকি এই লেখার সময়েও তা কাউন্সিলের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়নি। যাঁদের জন্য আইন করবেন, তাঁদের মতামত ছাড়া এধরনের পরিবর্তন কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? দ্বিখন্ডিত ইউনিয়নের একাংশের প্রতিনিধিত্ব (যাঁরা বিষয়টিতে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন) দেখিয়ে অংশীজনের সম্মতি দাবি করা যায় না।  


মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়েছে, ``এর মূল বিষয় হলো সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার মানোন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসাংবাদিকতা দূর করার লক্ষ্যে কাউন্সিল রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ইত্যাদি ক্ষুন্ন বা ভঙ্গের দায়ে অর্থদণ্ড দিতে পারবে বলে বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা অমান্যের দায়েও অর্থদণ্ড করা যাবে।`` তিনি জানান ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছিল; কিন্তু, মন্ত্রিসভা সেটি রাখেনি। অর্থাৎ অর্থদণ্ড থাকবে, কিন্তু টাকার পরিমাণটি বাদ দেওয়া হয়েছে। এ জরিমানার অর্থ সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। তিনি জানিয়েছেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হানিকর বা বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের আচরণবিধিমালার পরিপন্থী কোনো সংবাদ, প্রতিবেদন, কার্টুন, ছবি ইত্যাদি প্রকাশের দায়ে কাউন্সিল কোনো সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিতভাবে অপরাধ আমলে নিতে পারবে। সব রকমের প্রিন্ট ও ডিজিটাল গণমাধ্যম এর আওতায় পড়বে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কার্টুন প্রিন্ট বা ডিজিটাল গণমাধ্যমে দিলে সেটা যদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু হয়, তাহলে সেটি অপরাধ হবে। এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে প্রেস কাউন্সিলের সদস্যসংখ্যা ১৪ থেকে বাড়িয়ে  ১৭ করা হয়েছে। নতুন তিনজনের মধ্যে একজন হবেন তথ্য অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, আরেকজন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এবং অন্যজন হবেন সামাজিক সংগঠনের একজন নারী সদস্য। 


প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলো মোটেও সামান্য কিছু নয়। আদালত ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা রাখে কি না, সেটি একটি সাংবিধানিক প্রশ্ন। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য কী হানিকর বা পরিপন্থী তার কোনো স্পষ্ট সংজ্ঞা নেই। ক্ষমতাসীন দল, সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ফারাক যেখানে অনেক আগেই একাকার হয়ে গেছে, সেখানে এই বিধান সংযোজন মতপ্রকাশের ওপর বড়ধরনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। কার্টুন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিবেচনার বিধানও সৃজনশীলতার পরিপন্থী এবং এধরনের নিয়ন্ত্রণ সামরিক শাসনের আমলেও ছিল না। তথ্য অধিদপ্তর ও শিশু ও নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিত্বের নামে কাউন্সিলে আমলাদের আসন করে দেওয়া হলে তা প্রতিষ্ঠানটির চরিত্র বদলে দেবে। সংশোধনী আইনে রুপান্তরিত হলে কাউন্সিলের যেটুকু সমালোচনা এই লেখায় আছে, তা-ও দন্ডনীয় হতে পারে। 


প্রেস কাউন্সিলের ধারণাটি এসেছে মূলত সংবাদপত্রের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংরক্ষণের তাগিদ থেকে। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকার লক্ষ্যে সরকার যাতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে না পারে, সে কারণেই নিজেদের নীতি-নৈতিকতা ও জবাবদিহির একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা হিসাবে এই সাংবাদিকেরাই প্রেস কাউন্সিলের মত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। যুক্তরাষ্ট্রে অবশ্য সংবিধানে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার যে ধরনের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, সেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় কোনো স্বনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়নি। ইউরোপ ও ব্রিটেনে প্রেস কাউন্সিলের দীর্ঘ ইতিহাস আছে এবং তার বিবর্তন হয়েছে। প্রেস কাউন্সিলের জায়গায় এসেছিল প্রেস কমপ্লেইন্টস কমিশন। কিন্তু নাগরিকদের ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা লংঘনের কেলেংকারির পটভূমিতে তার বদলে গড়ে উঠেছে দুটি প্রতিষ্ঠান - ইপসো এবং ইমপ্রেস। কিছু পত্রিকা ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রেস স্ট্যান্ডার্ডস এসোসিয়েশনের (ইপসো) সদস্য হয়েছে, আর বাকিরা সদস্য হয়েছে ইমপ্রেস এর। দুটি প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতেই সরকারের কেউ নেই এবং তাদের নিয়ন্ত্রণেও সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। 


আমাদের প্রেস কাউন্সিল আর যুগোপযোগী নয়, কথাটা কঠিন শোনালেও সত্য। এর পরিবর্তন দরকার উন্নত দেশগুলোর আদলে, যাতে স্বনিয়ন্ত্রণের স্বাধীনতা আরও শক্তিশালী হয় ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানো যায়। আর পরিবর্তন পশ্চাৎ-মুখী হলে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে এবং মতপ্রকাশের অধিকার আরও সংকুচিত হবে। এতেবিদেশি সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে যে খবর ও মতামত প্রচা্রিত হবে, দেশীয় সংবাদমাধ্যমকে সেই খবর প্রচারের জন্য দন্ড গুণতে হবে, নয়তো তা সেন্সরের কাঁচিতে কাটা পড়বে। এমন ব্যবস্থা কখনোই কাম্য নয়।


(২২ জুন, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...