চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডকে প্রায় আশি ঘন্টা অগ্নিকুন্ডে পরিণত করেছিল যে দূর্ঘটনা, তার প্রাথমিক একটি কারণ হচ্ছে বিএম কনটেইনার ডিপোতে যে বিপজ্জনক দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য মজুত ছিল, তার কথা দমকলবাহিনীর সদস্যদের শুরুতেই জানানো হয়নি। তথ্যটি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাই সংবাদমাধ্যমের কাছে বলেছেন। অগ্নিনির্বাপক দলের সদস্যরা যদি তা জানতেন, তাহলে আগুন নেভাতে সেখানে পানি না ছিটিয়ে প্রয়োজনীয় ফোম ব্যবহার করতেন। তাঁরা ওই আগুন নেভানোর অভিযানে বিশেষধরণের পোশাক পরে যেতেন। এসব সাবধানতা মেনে কাজ করলে তাঁদের এরকম নির্মম মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতো। কনটেইনার ডিপোতে দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতের কথা অগ্নিনির্বাপকদের জানানোর কাজটি করা সম্ভব ছিল শুধু তাঁদের পক্ষে যাঁরা বিষয়টি জানতেন। অভিযোগ উঠেছে আগুন লাগার পর সেই রাতে মালিকপক্ষ অর্থাৎ কোম্পানির পরিচালকদের কেউ সেখানে যান নি। এই তথ্যগুলো কি কোম্পানিটির বিরুদ্ধে দায়িত্বহীনতার কারণে হত্যার অভিযোগ তোলার জন্য যথেষ্ট নয়?
ডাচ-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগ কোম্পানির পরিচালনাধীন কনটেইনার ডিপোতে যে দাহ্যপদার্থ মজুত ছিল তা যাঁদের জানার কথা, তাঁরা হলেন বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষ, চট্টগ্রামের বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কনটেইনার ডিপোটি বেসরকারি হলেও তা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করে। আর বিএম কনটেইনার ডিপোর পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেই ডিপোতে পণ্যসামগ্রী রাখা হয়। স্পষ্টতঃই সরকারের দুটি দপ্তরও এসব মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না।
খবরে আরও বলা হয়েছে যে ডিপোটি পরিচালনাকারী কোম্পানির পরিচালকদের কাছাকাছি এলাকায় একটি রাসায়নিক কারখানা আছে এবং সেই আল রাজী কেমিকেল লিমিটেডের রাসায়নিক সামগ্রীও ওই ডিপোতে সংরক্ষণ করা হচ্ছিলো (পদে পদে গাফিলতি কাড়ল ৪৯ প্রাণ, সমকাল, ৬ জুন, ২০২২)। রাসায়নিক পণ্য যেসব ড্রামে রাখা ছিল সেগুলোতে প্রয়োজনীয় সাবধানবাণী ও চিহ্ন দেওয়া ছিল না। আর যেধরণের অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা থাকার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে, তাতেও ঘাটতি ছিল।
মুনাফার হার বাড়াতে অথবা ধরে রাখতে খরচ কমানোর চর্চা বাংলাদেশের ব্যবসা–বাণিজ্যে নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে আইন-কানুন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দূর্বলতা, দূর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কর্মীদের নিরাপত্তা ও কল্যাণের বিষয়গুলো উপেক্ষিতই থেকে যায়। সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে সেরকম ইঙ্গিতই মিলছে, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের রাজনৈতিক পরিচয় - ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতৃত্বের পদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া ঘাটতি ও অনিয়মের অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের নীরবতা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তাদের প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে শুধু দাবি করা হয়েছে যে, `কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ডিপোতে কোনো পণ্যসামগ্রী রাখা যায় না` (সমকাল ৭ জুন, ২০২২)।
২
চট্টগ্রামের এই দূর্ঘটনা এমন সময়ে ঘটলো যখন দেশের মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে নাজেহাল হয়ে পড়েছেন। পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধির জন্য ঢাকায় রাস্তাতেও নেমে এসেছেন। স্বল্পসংখ্যক ধনী, প্রধানতঃ ব্যবসায়ীরা ছাড়া মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে কেউই মুক্ত নয়। সন্দেহ নেই, মূল্যস্ফীতির জন্য আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ইউক্রেনের যুদ্ধজনিত বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানি সংকট এবং মহামারিকালীন সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ার কারণগুলোর কথা বেশি বেশি করে উচ্চারিত হবে। টাকার মান কমে যাওয়ায় আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়ার বাস্তবতাও অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এর বাইরে অন্য কোনো কারণ আছে কিনা, সেটাও দেখা দরকার।
আজ অর্থমন্ত্রী যে বাজেট পেশ করবেন, তাতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতিকৌশল সম্পর্কে নিশ্চয়ই কিছুটা স্পষ্ট ধারণা মিলবে। তবে শুধু মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে মাথা ঘামানোই কি যথেষ্ট? যুক্তরাষ্ট্রে এখন যেমন শুরু হয়েছে লোভস্ফীতি নিয়ে আলোচনা, আমাদেরও কি তেমন আলোচনা দরকার নয়? যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে রাজনীতিকদের অনেকে এবং অর্থনীতিবিদদেরও কেউ কেউ অতিকায় কোম্পানিগুলোর অতিমুনাফার লোভকে গ্রীডফ্লেশন (greedflation) অর্থাৎ লোভস্ফীতি অভিহিত করে তাকে মূল্যস্ফীতি, তথা মুদ্রাস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। লোভস্ফীতি কীভাবে চিহ্নিত করা যাবে, তার উত্তর দিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমসের লিডিয়া ডিপিলিস ( ইজ গ্রীডফ্লেশন রিরাইটিং ইকনোমিকস, ৩ জুন, ২০২২)। তিনি তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বলেছেনঃ ১। খরচ বেড়ে যাওয়ার জন্য যতটুকু দাম বাড়ানো প্রয়োজন কোম্পানিগুলো কি তাদের পণ্যের জন্য তার চেয়েও বেশি দাম রাখছে? ২। যদি তা-ই হয়, তাহলে তা কি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় মূল্যস্ফীতি তৈরি করছে? এবং ৩। এটা কি সম্ভব হচ্ছে বাজারে বৃহৎ কোম্পানির ক্ষমতার জোরে, যে ক্ষমতা আগের দশকগুলোতে ছিল না?
বাংলাদেশের ভোজ্যতেলের বাজারের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে প্রশ্ন তিনটি মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। সংবাদপত্রগুলো হিসাব দিয়ে দেখিয়েছে দেশের ছয়টি বড় কোম্পানি ভোজ্যতেলের বাজারে প্রায় একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করে। দেশে তাদের যে মজুত ছিল, তাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার যৌক্তিক কারণ ছিল না। অর্থাৎ প্রয়োজন ছাড়াই তারা তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়েছিল। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর বিষয়টিতে গণশুনানির আয়োজন করলে তাদের সে উদ্যোগ এসব বড় কোম্পানির অসহযোগিতায় সফল হয়নি, বরং হঠাৎ করেই সরবরাহে রহস্যজনক ঘাটতি তৈরি হয়। এক যুগ আগেও বাজারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা এভাবে কেন্দ্রীভূত ছিল না। ভোজ্যতেলের এ মডেলটি - যাকে অনেকে সিন্ডিকেট বলে অভিহিত করেন - ক্রমশই অত্যাবশ্যকীয় অন্যান্য পণ্যের বাজারেও অনুসৃত হতে চলেছে বলেই মনে হয়।
৩
প্রশ্ন হচ্ছে লোভস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার কী করতে পারে? তবে তার আগে বোধহয় জানা দরকার সরকার আদৌ তা করতে চায় কিনা। অন্য কথায় লোভস্ফীতি মূল্যস্ফীতিকে সমস্যায় পরিণত করছে বলে সরকার স্বীকার করে কিনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানার একটি মন্তব্য এক্ষেত্রে উদ্ধৃত করা প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি চিনি কলগুলোর সংকট নিয়ে ডেইলি স্টার পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে, সরকারের স্বার্থকে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন। জনস্বার্থ এখন পিছনে চলে গেছে (মিসম্যানেজমেন্ট, বেনিফিটস টু ট্রেডারস ডেস্ট্রয়িং আওয়ার সুগার মিলস, ৪ জুন, ২০২২) ।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালও গবেষণা করে দেখিয়েছে সংসদের ৬১ শতাংশ সদস্যই ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ীরাও বাজারে প্রতিযোগিতা চান বলে মনে হয় না। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঠিকাদারি, লাইসেন্স ও সরবরাহ ব্যবস্থার রফা হয়। ফলে বৃহদাকারের কিছু কোম্পানি একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার ও বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায় ও তা কব্জা করে। ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সমিতি গঠনের বেলাতেও ক্ষমতাসীন দলের লোকদের নেতৃত্বে বসানোর যে সব তৎপরতা দেখা যায়, তাতেও বোঝা যায় এসব সমঝোতার পথ সুগম করাই তাঁদের অন্যতম লক্ষ্য। যোগসাজশের মত রাজনৈতিক পরিভাষা ব্যবহার না করেও বলা যায় যে এসব বোঝাপড়ার পিছনেও উদ্দেশ্য একটিই - বাজারকে প্রভাবিত করা এবং তার কারণ লোভস্ফীতি।
লোভস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উপায় নিয়ে খুব বেশি আলোচনার কিছু নেই। মুক্ত বাজার মানে যে নিয়মনীতিবর্জিত বাজার বা `জোর যার বাজার তার` নয়, সেটা নিশ্চিত করতে সরকারের কিছু করণীয় আছে। প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে একচেটিয়া আধিপত্যের যেকোনো উদ্যোগ ভেঙ্গে দেওয়া, আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক তদারকির ব্যবস্থা এগুলো সবই অবশ্য নির্ভর করে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার উপর। কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া সেই জবাবদিহিতা কি আদৌ সম্ভব?
(৯ জুন, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন