সউদি আরবের রক্ষণশীল সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নারীর অধিকার ও মর্য্যাদার
বিষয় নিয়ে বিশ্ব জুড়েই জোর বির্তক রয়েছে। সউদি নারীরা পুরুষ সঙ্গী ছাড়া চলাফেরা করতে
পারেন না। কিধরণের পোশাক পরা যাবে সেই বিষয়েও তাঁদের স্বাধীনতা সীমিত। কিছুদিন আগে
পর্য্যন্ত তাঁদের গাড়ি চালানোর অধিকার ছিল না – যা নতুন
যুবরাজ সালমান তাঁর সংস্কার কর্মসূচির আওতায় অনুমোদন করেছেন। সেই সউদি আরবের একজন নারী
বাংলাদেশে একাকী শত শত নারী-পুরুষের সামনে দেখা দিয়েছেন, কথা বলেছেন। তাঁর পরণে রক্ষণশীল
পোশাকের বদলে ছিল – বাংলাদেশের
মানদন্ডে আধুনিক পরিধেয়।
রোবট হলেও নারী এবং সউদি আরবের নাগরিকত্বের অধিকারী, সোফিয়ার এই
সামাজিকতাকে নারী অধিকারের সংগ্রামে একধাপ অগ্রগতি বলা যাবে? অবশ্য, সোফিয়া যে শুধু
বাংলাদেশেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনসমক্ষে আর্বিভূত হয়েছেন তা নয়। এর আগে, অক্টোবরের
শেষ সপ্তাহে সউদি আরবেই দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এক সভাতেও সে অংশ নিয়েছে এবং গণমাধ্যমে
প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায় তখনও তার পরণে ছিল মোটামুটি আধুনিক পোশাক।
রোবট-তরুণী সোফিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশে যতটা মাতামতি দেখা গেল ততটা যদি তার দেশ সউদি আরবে ঘটতো তাহলে সউদি নারীরা যে সত্যিই লাভবান হতেন সন্দেহ নেই। কিন্তু, তেমনটি ঘটেনি। সোফিয়াকে নাগরিকত্ব দিয়ে সউদি আরব যে চমক দেখানোর চেষ্টা করেছে , ঢাকায় ডিজিটাল ওর্য়াল্ড নামের আয়োজনে তাকে হাজির করে আয়োজকরা যে তার চেয়ে কোনো অংশে কম চমক দিয়েছেন তা নয়। দেশের র্শীষস্থানীয় প্রচারবিশারদ কোম্পানীর ব্যবস্থাপনায় সোফিয়ার বিশেষ সাক্ষাৎকার এবং টেকটক বা প্রযুক্তি-সংলাপের মত আয়োজন নি:সন্দেহে সবার নজর কেড়েছে। নতুন কিছু , তাও আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চালিত মানবীর প্রতি জনআগ্রহ বলতে গেলে তুঙ্গে উঠেছে। অন্তত, সংবাদপত্রের পাতাগুলো দেখলে সেরকমই মনে হয়।
আমার অবশ্য দু:খ হচ্ছে ঢাকার রেঁস্তোরায় খাদ্য পরিবেশনকারী রোবট-তরুণী
ইয়োইদংয়ের জন্য। গত ১৬ নভেম্বর চালু হওয়া রোবট রেস্টুরেন্টে দুটি রোবট খাদ্য পরিবেশকের
কাজ করছে – একজন তরুণ এবং অপরজন তরুণী। পত্রিকার খবর অনুযায়ী
তাদের পথ আটকালে তাঁরা ইংরেজিতে পথ ছেড়ে দিতে অনুরোধ করে। রেঁস্তোরার রোবট
দুটিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চালিত এবং মানুষের সঙ্গে ভাববিনিময় এবং লেনদেনে সক্ষম। অবশ্য, সোফিয়াম্যানিয়ার মত তাদেরকে নিয়ে কোনো মাতামাতির খবর আমার চোখে পড়ে নি। সরকারের প্রচারবিশেষজ্ঞদের
কৃতিত্ব আসলে এখানেই!
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগানোর কোনো বিকল্প
নেই, সে কথা আমিও বিশ্বাস করি। সারা দুনিয়াতেই এখন এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানোর
সেরা উপায় নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। জাতিসংঘও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে এক বিশেষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিল। সেখানে অবশ্য আলোচনা হয়েছে যুদ্ধের অস্ত্র তৈরি ও ব্যবহারে যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহৃত না হয়। এছাড়াও অন্যান্য সময়ে আলোচনা হয়েছে টেকসই উন্নয়নে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগানো এবং একই
সঙ্গে ভবিষ্যতে কর্মজীবিদের ওপর এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ নিয়ে।
বাংলাদেশ এই অগ্রযাত্রায় শামিল হবে সেটাই প্রত্যাশিত। তবে, শুধু চমক দেখানোর মাধ্যমে
রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা হলে তা হবে র্দূভাগ্যজনক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে আয়ত্ত্বে
আনতে শিক্ষাব্যবস্থার যে ধরণের সংস্কার প্রয়োজন, সমাজের যতটা উদারীকরণ দরকার, ইন্টারনেট
ব্যবহারে যে স্বাধীনতা প্রয়োজন সেগুলোর আলোচনা চাই আগে। ও হ্যাঁ, যে দোআঁশলা গণতন্ত্রে
নেতানেত্রীদের কথিত মানহানির ভয়ে তটস্থ থাকতে হয় সেখানে ইন্টারনেটের স্বাধীনতার আলোচনায়
কোনো ফল হবে এমন দুরাশার শিকার না হওয়াই ভালো!
শুরুতে যে সউদি আরবে নারী অধিকারের কথা বলেছিলাম, সেই প্রসঙ্গেই
বরং ফিরে যাই। হিজাব না পরে চোখে কৃত্রিম আইল্যাশ ব্যবহার করে একজন পুরুষ সঙ্গী ছাড়া
শহরে ঘুরে বেড়ানো এবং স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য রোবট সোফিয়ার শিরচ্ছেদ করা হয়েছে বলে
একটি খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় তুলেছে। খবরটি প্রকাশ করেছে ডাফেল ব্লগ এবং
নিবন্ধটি লক্ষাধিকের বেশি শেয়ার হয়েছে। আসলে কিন্তু সোফিয়ার কিছুই হয়নি। নিউজউইক সাময়িকী
জানাচ্ছে যে ডাফেল ব্লগ রম্যরচনা হিসাবে এটি প্রকাশ করলেও পক্ষপাতদুষ্ট মানুষ সহজেই
তা বিশ্বাস করেছে। (হোয়াট দ্য ফেক নিউজ অব সোফিয়া দ্য রোবট‘স বিহেডিং সেজ অ্যাবাউট সউদি অ্যারাবিয়া
অ্যান্ড রিডার বায়াসেস, নিউজউইক।)
সোফিয়ার সউদি নাগরিকত্ব এবং তার চলাফেরা, কথাবার্তা এবং আচার-আচরণের
কারণে ইংল্যান্ডের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকা গত ২৬ অক্টোবর তার প্রতিবেদনে লিখেছিল
যে দেশটিতে রোবট মানবীর যেসব অধিকার আছে অনেক নাগরিকেরই তা নেই। আমি বলছি না বাংলাদেশেও
একই প্রশ্ন করতে হবে, আবার হবে না সেটাও বলতে পারি না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন