ঠিক
একবছর আগের কথা , দিনটা ছিল রোববার। তবে, তারিখ একই – ১১ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টকে
সেদিন সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলো যে রাষ্ট্রপতি মনে করেন নিম্ন আদালতের বিচারকদের
শৃংখলাবিধির বিষয়ে কোন গেজেট প্রকাশের প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রপতি এমন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন
বলে আইন মন্ত্রণালয় একটি নোটিশ জারি করে এবং সেই নোটিশের কথা আদালতকে জানান অ্যাটর্নি
জেনারেল মাহবুবে আলম। এর কয়েক মাস আগে থেকেই এই শৃংখলাবিধির খসড়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে
সরকার সময়ক্ষেপণের কৌশল অনুসরণ করে আসছিল। এখন গত ১১ ডিসেম্বর সোমবার রাষ্ট্রপতি নিম্ন
আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধির গেজেট প্রকাশ করলেন। কিন্তু, সরকারী ঘোষণায় রাষ্ট্রপতি
কেন সিদ্ধান্ত বদলালেন তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না।
২০১৬
সালের ১১ ডিসেম্বর আইন মন্ত্রণালয় রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত হিসাবে যে নোটিশ জারি করেছিল
সেটি কি তাহলে ভুল ছিল? ওই ভুলের ব্যাখ্যা কি? দেশের বিদ্যমান
শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতির মোহর বা স্বাক্ষর সরকার যে যথেচ্ছভাবে ব্যবহারে সক্ষম এই
সিদ্ধান্তে কি তা আবারও প্রমাণ হলো না?
মঙ্গলবারের
সংবাদপত্রগুলোতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের একটি মন্তব্য বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে।
নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধি গেজেট আকারে প্রকাশে দেরি হওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা
করতে গিয়ে তিনি বলেছেন ‘এক ব্যাক্তির রাজনীতিকরণের
চেষ্টার কারণে বিলম্বিত হয়েছিল। তিনি সরে যাওয়ায় সংকট দূর হয়েছে‘। আইনমন্ত্রী ওই ব্যাক্তির
নাম উল্লেখ না করলেও সংবাদমাধ্যম সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাই ওই ব্যাক্তি বলে
ধরে নিয়েছে। সংবাদমাধ্যমের এই অভিন্ন ধারণা সঠিক না হলে এবিষয়ে অচিরেই একটি ব্যাখ্যা
আশা করি। নাহলে যেকোন নাগরিকই এবিষয়ে নিসংশয়ভাবে ধরে নেবেন যে আইনমন্ত্রী সাবেক প্রধান
বিচারপতি এস কে সিনহাকেই বুঝিয়েছেন। একটি সৎ স্বীকারোক্তির জন্য সেক্ষেত্রে আইনমন্ত্রীর
ধন্যবাদও প্রাপ্য। একজন ব্যাক্তির থাকা না থাকায় কতকিছুর ক্ষেত্রেই যে পরিবর্তন ঘটতে
পারে তার নমুনা আমরা সবাই দেখেছি। প্রধান বিচারপতি হিসাবে মি সিনহার আমন্ত্রণে আপিল
বিভাগের বিচারপতিদের সঙ্গে বৈঠক করার সময় হয়নি আইনমন্ত্রীর। কিন্তু, তাঁর অবর্তমানে
একাধিক বৈঠক সম্ভব হয়েছে। এমনকি, নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধি নিয়েও তাঁরা একমত
হয়েছেন বলে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন।
সাবেক
প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে সরকারের অনেকগুলো অভিযোগ আছে। তবে, সরকার একটি
অভিযোগও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করে নি এবং বাংলাদেশের কোনো থানা, আদালত বা অন্য আইনগত
সংস্থায় (যেমন দূর্নীতি দমন কমিশন) এখনও পর্য্যন্ত কোনো অভিযোগনামা বা মামলা
দায়েরের ঘটনা ঘটেনি। তাঁর বিরুদ্ধে দূর্নীতি, বিদেশে টাকা পাচার এবং অপেশাদার বা অনৈতিক
আচরণের যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সরকারী সংস্থা বা ব্যাক্তিসূত্রে সরকারসমর্থক সংবাদমাধ্যমে
প্রচার করা হয়েছে তার অনেকগুলোই তিনি প্রধান বিচারপতির দায়িত্বলাভের আগের ঘটনা । তাঁকে
প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তাই স্বভাবতই দুটো প্রশ্ন ওঠে। এতোটা গুরুত্বর্পূণ
সাংবিধানিক পদে নিয়োগের আগে সম্ভাব্য প্রার্থীর সততা ও যোগ্যতার বিষয়গুলো যাচাইয়ের
কোন ব্যবস্থা কি কার্যকর আছে? নাকি, সরকার জেনেশুনে রাজনৈতিক সুবিধা ( যেমন সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে রাষ্ট্রের শীর্ষপর্যায়ে নিয়োগ দেওয়ার কৃতিত্ব) নেওয়ার জন্যই
একজন র্দূর্নীতিগ্রস্ত ব্যাক্তিকে বেছে নিয়েছিল?
আইনমন্ত্রীর
বক্তব্য অনুযায়ী যদি শুধূমাত্র এস কে সিনহার জন্য নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধি
চূড়ান্ত করে গেজেটপ্রকাশ আড়াইবছর ধরে আটকে থেকে থাকে তাহলে নতুন করে কিছু প্রশ্নের
উত্তর পাওয়া আমাদের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। প্রথমত: সরকার এস কে সিনহাকে বিদায় দিতে চেয়েছে
এবং তাতে সফল হয়েছে। এখন এমন প্রশ্নও উঠতে পারে যে তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ প্রচার
করা হয়েছে সেগুলোর তাঁর চরিত্রহননের মাধ্যমে তাঁর ওপর চাপপ্রয়োগের জন্যই করা হয়েছে
কিনা। নাহলে তাঁর পদত্যাগের দেড় মাস পরও কোন আইনগত ব্যবস্থা শুরু হয় নি কেন? দ্বিতীয়ত:
প্রধান বিচারপতিকে সরে যেতে বাধ্য করা সম্ভব হলে দেশের অন্য যেকোনো বিচারকের ক্ষেত্রেই
তা সম্ভব হতে পারে। তৃতীয়ত: আমাদের উচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্টেও কি এক ব্যাক্তির শাসন
চলে? নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধির বিষয়ে আপিল বিভাগের সাতজন বিচারপতির কেউ
কখনো ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন এমনটি জানা যায় না। তাহলে, সরকারের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টির
দায় এককভাবে বিচারপতি সিনহার হয় কি করে?
সরকারের
ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন আরও লক্ষ্যণীয় হয় আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যে। ভারপ্রাপ্ত
প্রধান বিচারপতির বিষয়ে রাষ্ট্রপতির প্রজ্ঞাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পরও তিনি ওই
দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। নতুন কোনো গেজেট হয় নি। আবার নতুন প্রধান বিচারপতি নিয়োগের
বিষয়টিও অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে আছে। প্রধান বিচারপতির শপথ না নিয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান
বিচারপতি কি কি করতে পারেন অথবা পারে না তা নিয়ে বিতর্কের মুখে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন
‘রাষ্ট্র জনগণের তাই টেকনিক্যাল
প্রশ্ন বড় হতে পারে না‘
(প্রধান বিচারপতির
পদে শূণ্যতা সংবিধান সমর্থন করেনা , প্রথম আলো, ১২ ডিসেম্বর) । জনগণের রাষ্ট্রে কতৃত্ব
করেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আর, সেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ‘আমিই রাষ্ট্র‘ মনোবৃত্তির প্রভাব বিচারবিভাগের
ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কাম্য নয়।
নিম্ন
আদালতের বিচারকদের শৃংখলাবিধির বিষয়ে বিতর্কের আরেকটি গুরুত্বর্পূণ উপাদান হচ্ছে ১৯৭২
এর সংবিধান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক পরিচয় দিতে ভালোবাসে যে সরকার সেই রাজনৈতিক
সরকারের দ্বৈতনীতির বহিপ্রকাশ দেখা যায় এই পদক্ষেপে। স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অন্যতম
স্বপ্ন ছিল স্বাধীন বিচারবিভাগ প্রতিষ্ঠা। যেকারণে, বাহাত্তরের সংবিধানে নিম্ন আদালতের
তদারকি বা নিয়ন্ত্রণের ভার সরকারের হাতে না রেখে তা অর্পিত হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের
ওপর। সরকার সবকিছুতেই বাহাত্তরের সংবিধানে ফেরার কথা বললেও যে গুটিকয়েক বিষয়ে তাদের
আপত্তি তার একটি হচ্ছে নিম্ন আদালতের তদারকি ক্ষমতা। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের আদি
অবস্থায় প্রত্যাবর্তনের ঘোর বিরুদ্ধে তাঁরা। অথচ, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের
ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে তাঁরা অব্যাহতভাবে বাহাত্তরের সংবিধানের দোহাই দিয়ে
চলেছেন।
এর
কারণটি বুঝতেও আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ষোড়শ সংশোধনীর মামলার রায়ে আমরা জেনেছি
যে দেশে যত মামলা হয় বা যত মামলা বিচারাধীন আছে তার আশি শতাংশেই সরকার একটি পক্ষ। সরকার
যে কোথাও হারতে চায় না তা আমরা সবাই জানি। সুতরাং, বিচারকদের শৃংখলাবিধানের দায়িত্ব
যদি সরকারের হাতে থাকে তাহলে কোন বিচারক স্বাধীন এবং ন্যয়পরায়ণতার নীতিতে অটল থাকার
দু:সাহস দেখাবেন? সরকারের সঙ্গে দ্বন্দের পরিণতি সাম্প্রতিকতম দৃষ্টান্ত কি তাঁদের
জন্য একটি জোরালো দৃষ্টান্ত নয়? ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ আবেদনের ফল কি দাঁড়াবে সেই
শংকার মধ্যেই নিম্ন আদালতের ওপর এই নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হলো।
বিচারপতিদের নিয়োগ, পারিশ্রমিক, পদোন্নতি এবং অপসারণের
মতো বিষয়গুলো নির্বাহী বিভাগের প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা বিশ্বজুড়ে এখন একটি সর্বজনীন
চর্চায় রূপ নিয়েছে। সে কারণেই আন্তর্জাতিক পরিসরে এসব নীতিমালা তৈরি হয়েছে বিভিন্ন
দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে। জাতিসংঘের তত্ত্ববধানে তৈরি হয়েছে ব্যাঙ্গালোর নীতিমালা এবং
কমনওয়েলথ জোটে তৈরি হয়েছে লাটিমার হাউস নীতিমালা। এসব নীতিমালায় স্পষ্ট ভাষায় বলা আছে,
‘বিচারকেরা তাঁদের আচরণের জন্য জবাবদিহি করবেন বিচারব্যবস্থার
মান বজায় রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত এমন প্রতিষ্ঠানের কাছে, যেটি হবে স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ।’ ল্যাটিমার হাউস প্রিন্সিপলস
বলছে, অসদাচরণ বা অক্ষমতার অভিযোগে অভিযুক্ত বিচারককে ‘একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালে’ শুনানির সুযোগ দিতে হবে। কমনওয়েলথ দেশগুলোর বিদ্যমান বভ্রবস্থা পর্যালোচনা
করে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, একেকটি অভিযোগের সময় একেকটি
ট্রাইব্যুনাল গঠন কিংবা এক ব্যক্তিনির্ভর কোনো ট্রাইব্যুনাল না হওয়াই ভালো। কেননা,
তাতে অভিযুক্ত বিচারকের প্রতি কোনো ধরনের সহানুভূতি বা বিদ্বেষ দেখানোর ঝুঁকি কমানো
সম্ভব। একটি স্থায়ী কমিশন বা ট্রাইব্যুনালে এ ধরনের প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা কম (দ্য
অ্যাপয়েন্টমেন্ট, টেনিওর অ্যান্ড রিমুভাল অব জাজেস আন্ডার কমনওয়েলথ প্রিন্সিপলস: আ
কম্পেন্ডিয়াম অ্যান্ড অ্যানালাইসিস অব বেস্ট প্র্যাকটিস)।
আমাদের সদ্য জারি করা শৃংখলাবিধিতে তার উল্টোটাই করা
হয়েছে। শৃংখলাবিধির ছত্রে ছত্রে অভিযোগ পাওয়া এবং প্রাথমিক
তদন্তের মত বিষয়গুলোতে ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ‘ অভিধা ব্যবহৃত হয়েছে। আর উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যায়
রাষ্ট্রপতি বা রুলস অব বিজনেসের আওতায় সার্ভিস প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়
বা বিভাগকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যার মানে দাঁড়াচ্ছে প্রধানত আইন মন্ত্রণালয়
এবং প্রেষণে নিযুক্ত বিচারবিভাগীয় কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ওই মন্ত্রণালয়ের কর্তৃপক্ষ
বিচারকদের ওপর কর্তৃত্ব করবেন। আর, সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা একেবারেই পরামর্শকের পর্যায়ে
নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের পরও কথিত ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষে‘র ওপর নির্ভর করবে চূড়ান্ত ব্যবস্থা। এতে করে আমলাতন্ত্রিক
(কখনও কখনও ইচ্ছাকৃত) সময়ক্ষেপণের কারণে সুপ্রিম কোর্ট চাইলেও সেই চাওয়া অর্পূণ থাকার
আশংকা থেকেই যাবে। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা খর্বের এই সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ আমাদের কারো
জন্যই মঙ্গল বয়ে আনবে না।
(প্রথম আলোয় ১৪ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার প্রকাশিত আমার কলাম বিশ্বায়নের কাল।)
http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1386726/%E0%A6%AC%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A7%87-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন