২০১৮কে স্বাগত জানাতে ঢাকার আকাশে ফানুস ওড়ানোর এবং মুর্হুমুহু পটকা
ফুটানোর প্রতিযোগিতার ছবি ও ভিডিওতে সোশাল মিডিয়া এখন সয়লাব। কিন্তু, পুলিশের নিষেধাজ্ঞা
ছিল ঢাকায় এমনকি বাড়ির ছাদেও কোনো উৎসব চলবে না।এধরণের উৎসব-অনুষ্ঠানের সময়ে পুলিশের নিরাপত্তামূলক নির্দেশনা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, এবারে ছিল চোখে পড়ার মত বাড়াবাড়ি। কিন্তু, হেলিকক্টার নিয়ে টহল দিয়েও ঢাকাবাসীকে খুব একটা নিবৃত্ত করা যায় নি। পুলিশের পক্ষে বেডরুম পাহারা দেওয়া যে সম্ভব না সেকথা আমরা বছর
কয়েক আগেই শুনেছি। এখন বোঝা গেল বাড়িঘরের ছাদ পাহারা দেওয়া কোনোভাবেই তার চেয়ে সহজ
নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের থার্টিফাস্ট নাইট বা নববর্ষ
পালনে বাধা দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন? এটি কি শুধুই আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা? নাকি এর পিছনে
কোনো রাজনৈতিক কারণও আছে? দেড়যুগ আগে রমনায় ভোরের আলোয় বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানে ঘৃণ্য
সন্ত্রাসী হামলার পর খোলা জায়গায় উন্মুক্ত উৎসব আয়োজনে নিরাপত্তার বিষয়টিতে বিশেষভাবে
গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। লাখো মানুষের অংশগ্রহণের ওই অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক
আয়োজনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করায় পুলিশ বেশ ভালোই কৃতিত্ব অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক
বছরগুলোতে একাধিক জঙ্গি হামলার পর সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবেলায় পুলিশ উল্লেখযোগ্য
সাফল্য দেখিয়েছে। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশেও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করায় পুলিশের ভালো অভিজ্ঞতা
আছে। ঢাকায় সপ্তাহজুড়ে রাতভর যে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের উৎসব হয়েছে সেখানেও জোরদার নিরাপত্তার
ব্যবস্থা ছিল। সুতরাং, রাতেরবেলায় নববর্ষের উৎসব আয়োজনে নিরাপত্তা দেওয়ার সামর্থ্য
পুলিশের নেই এমনটি মনে করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।
মধ্যরাতে নতুন বছর আবাহনের আয়োজনে বিশৃঙ্খলা এবং অপ্রীতিকর ঘটনার
রেকর্ড যে নেই তা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একজন নারীর লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনায় সংসদে
আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ জয়নাল হাজারির মন্তব্য যে বিতর্কের ঝড় তুলেছিল তা সহজে ভোলার
নয়। কিন্তু, সেই অঘটন ঘটেছিল গত শতকের শেষপ্রান্তে। অভিজাত এলাকা গুলশানেও দুএকটি অপ্রীতিকর
ঘটনার খবর গণমাধ্যমে ছাপা হয়েছে। কিন্তু, তারপরও প্রতিবছরই পুলিশের যুক্তিসঙ্গত নিরাপত্তামূলক
নির্দেশনা মেনে ঢাকায় মধ্যরাতে নববর্ষের উৎসব হয়ে এসেছে। পুলিশের সবচেয়ে বড় মাথাব্যাথার
কারণ ছিল মাদকদ্রব্যের ব্যবহার এবং মাতলামির আশংকা। ২০১৩ সাল পর্য্যন্ত সংবাদপত্রের
পাতা উল্টালে দেখা যায় প্রতিবছরই মধ্যরাতে ঢাকায় উৎসব-আতশবাজি হয়েছে, রাজপথেও তরুণরা নেচে-গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করেছেন।
২০১৪তে এই ধারায় ছেদ পড়ে। প্রধানত: ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধীদলগুলো
বয়কট করায় যে রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হয় তার পটভূমিতে সেবছর ঢাকায়
কোনো নববর্ষ উদযাপনের কোনো আয়োজন হয়নি। নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সহিংসতা ছাড়াও আরও
একটি বিষয় এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন – সেটি হচ্ছে
হেফাজতে ইসলামের উত্থান। অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং কট্টর ধর্মীয় নীতি নির্দেশনা বাস্তবায়নই
হচ্ছে হেফাজতের মূল উদ্দেশ্য। ২০১৩ সালে হেফাজত ও বিরোধীদল বিএনপির মধ্যে একধরণের বোঝাপড়ার
কারণে অস্থিরতা তৈরি হলে সরকার তা কঠোর হাতে দমন করলেও পরবর্তীতে তাদের অনেক দাবিই
বিনা ঘোষণায় সরকার মেনে নিয়েছে। এর সর্বসাম্প্রতিক নজির হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে অঘোষিত
রদবদল। গেলবছর হেফাজতের দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট ভবনের সামনে স্থাপিত গ্রীক দেবির
ভাস্কর্য্যটি শেষপর্য্যন্ত সরিয়ে পিছনের দিকে নেওয়া হয়। হেফাজত তাদের ভাষায় সবধরণের বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রচার-প্রসারের বিরোধী।
পহেলা জানুয়ারি খৃষ্টীয় বছর শুরু হয় বলে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো অনেকদিন
ধরেই ইংরেজি বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বিরোধীতা করে আসছে। বাংলা বর্ষবরণের আয়োজনগুলোতেও তাদের আপত্তি। ২০১৮
নির্বাচনের বছর হওয়ায় এসব রক্ষণশীল ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের রাজনৈতিক সমর্থন ক্ষমতাসীন
দলের জন্য খুবই গুরুত্বর্পূণ। মধ্যরাতের আয়োজনে পুলিশের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পিছনে এই
রাজনীতির কোনো ভূমিকা নেই সেকথা কি নিশ্চিত করে বলা যাবে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন