সদ্য অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সম্মেলনে অর্থশাস্ত্র ও
নৈতিকতা বিষয়ক বক্তৃতায় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন দেশের
ব্যাংকিং খাতে নৈতিকতার সংকট চলছে। সংকটের পুরোটাই খেলাপি ঋণকে ঘিরে উল্লেখ করে তিনি
বলেন অধিকাংশ ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঋণের অর্থ পরিশোধ না কৌশল জেনে গেছেন।
ফলে খেলাপি ঋণ পুনঃ তফসিল করার ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। এটি আর্থিক খাতের প্রতিযোগিতা
সক্ষমতা ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ জন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় রাজনীতিকরণ ও নিয়ন্ত্রকের ব্যর্থতাই
দায়ী। তাঁর কথায় ব্যাংকার, ব্যাংক মালিক বা রাজনৈতিক সংযোগ থাকলেই ঋণ পাওয়ায় বিশেষ
সুবিধা পাওয়া যায়।
ওই সম্মেলনেই বাংলাদেশ
ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান বলেছেন,
আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা বাংলাদেশ ব্যাংকের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। এ স্বার্থ
রক্ষা হচ্ছে না, এটা এখন বহুল আলোচিত। জনগণের অর্থের নিরাপত্তায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে
সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।
ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকসের অর্থনীতি
বিভাগের অধ্যাপক মুহম্মদ মাহবুব আলীও সেখানে বলেছেন, ব্যাংকে এক পরিবার থেকে চার পরিচালক
ও একাধিক মেয়াদ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। দেশে ব্যাংক বেশি হয়ে পড়েছে, এখনই
একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ব্যাংকিংখাতের দূর্দশায় দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা এখন প্রকাশ্যেই
হতাশা এবং উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বলা চলে গত নয় বছর ধরে ‘অর্ধেক গ্লাস
ভরা‘
তত্ত্বের
ধারায় অর্থনীতির যেসব বিশ্লেষণ শুনে আমরা অভ্যস্ত তাতে একটি ছেদ ঘটেছে।
অস্বস্তিকর ভুল এবং দূর্বলতা অস্বীকারের চর্চা রাজনীতিকদের মধ্যে
নতুন কিছু নয়। রাজনীতিকদের এই চর্চা প্রশাসনে সংক্রমিত হবে সেটাও অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু,
কিছু কিছু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান – বিশেষত যারা ভুল-ভ্রান্তি
ধরিয়ে দেওয়া এবং তা সংশোধনের দায়িত্বে থাকেন সেরকম নিয়ন্ত্রক বা তদারকি প্রতিষ্ঠানের
কাছে তা প্রত্যাশিত নয়। এসব প্রতিষ্ঠানের সততা, নিরপেক্ষতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য
সুশাসন বা আইনের শাসনের জন্য অপরিহার্য্য। কিন্তু, অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তপনায় অভ্যস্ত
কয়েকটি গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতিকদের যোগসাজশ এবং আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ
বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে এক অদৃশ্যর্পূব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য দিয়ে আমরা উন্নয়নের যেসব চিত্র
প্রচার করছি তাতে অনেক ক্ষেত্রে বাহবা মিলছে ঠিকই কিন্তু ভেতরের ঘুণধরা
অংশের পচনটাও কিন্তু পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। ব্যাংকিংখাতের চাপা সংকট এখন ক্রমশই প্রকাশ
হতে শুরু করেছে। দেশের আইরেও আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যম এবং বিনিয়োগ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলো
এখন ব্যাংকিংখাতের এসব সমস্যার দিকে নজর দিয়েছে। অর্থ-বাণিজ্য
বিষয়ক সংবাদমাধ্যম ব্লুমর্বাগ ফিচ (Fitch) রেটিং এজেন্সির গবেষণা প্রতিষ্ঠান,
বিএমআই রিসার্চের একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে সম্পদের
মান কমতে থাকা এবং মূলধনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পাওয়া অব্যাহত থাকবে ( বাংলাদেশ ফায়ার্স টু
ব্যাংক সিইও্স ইন এ মান্থ, সিক্স টু অ্যার্ভাট ক্রাইসিস, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৭)। এর কারণ
হিসাবে তারা দূর্বল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো এবং অব্যবস্থাপনার কথাই বলেছে। প্রতিবেদনে বলা
হয়েছে খেলাপি ঋণ আর মাত্র পনেরো শতাংশ বাড়লেই ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৭টি সেই ধাক্কা
সামলাতে সক্ষম হেবে। বিএমআই রিসার্চের এশীয় দেশগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়ন বিভাগের প্রধান
সুয়া হান তং ব্লুমবার্গকে বলেছেন দূর্বল আইনী কাঠামো এবং দেউলিয়া ঘোষণার প্রক্রিয়া
দীর্ঘ হওয়ার কারণে সেখানে ঋণগ্রহীতাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি
বিরাজমান। ফলে, মন্দ-ঋণে পরিণত হওয়া অনেকগুলোরই কারণ হচ্ছে ঋণখেলাপির অভ্যাস।
এলজি গ্লোবাল নামের আরেকটি বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠানের
মূল্যায়েন বলা হচ্ছে সমগোত্রীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকিংখাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ
সবচেয়ে বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে গত নয়বছরে করদাতাদের টাকায় নতুন করে মূলধন
যোগান দেওয়া হলেও সেগুলোর উন্নতি হয়নি। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর বিষয়ে এই প্রতিষ্ঠানের
মূল্যায়ন বলছে এসব ব্যাংকের ভাগ্য নির্ভর করছে তাদের শীর্ষ তিনজন ঋণগ্রহীতাদের ওপর। এসব
বেসরকারী ব্যাংকের প্রত্যেকেরই শীর্ষ তিনজন ঋণগ্রহীতা যদি দেউলিয়া হয়ে পড়েন তাহলে অর্ধেক
ব্যাংকই ন্যূনতম মূলধন টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে না। এলজি গ্লোবাল বলছে বাংলাদেশের অধিকাংশ
বেসরকারী ব্যাংকই কিছু পরিবার এবং তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা
নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে সম্প্রতি যে সংশোধনী আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে
তার ফলে এই খাতে অল্প কয়েকজনের নিয়ন্ত্রণ বাড়বে। এই সংশোধনীর ফলে একই পরিবার থেকে পরিচালকসংখ্যা
দ্বিগুণের জায়গায় বেড়ে চারজন হবে এবং পরিচালকদের মেয়াদ ছয়বছর থেকে নয়বছরে বাড়বে।
চলতি বছরের ৮ মে মন্ত্রীসভায় এই নতুন সংশোধনী অনুমোদিত
হওয়ার পর মন্ত্রীপরিষদ সচিব শফিউল আলম স্পষ্টভাষায় স্বীকার করেছেন ব্যাংক পরিচালকদের
সুযোগ বাড়িয়ে এসব সংশোধনের জন্য ব্যাংকাররা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। তিনি
আরও বলেন একই পরিবার অর্থায়ন করে, বিনিয়োগও তারাই করে। পারিবারিকভাবে বিনিয়োগ করেন
বলে তাঁদের অ্যাফিলিয়েশন বা মায়া থাকে। ব্যাংক মালিকদের দাবি ছিল, তাঁর ভাষায়, যারা
প্রতিষ্ঠকালে পরিচালক হিসাবে বিনিয়োগ করেন তাদের পরে কিছু বলার থাকে না। অন্য লোকজন
এসে মাঝখানে কিছু নিয়ে চলে যায়।
মন্ত্রীপরিষদ সচিবের বক্তব্যে তিনটি বিষয় খোলাসা হয়েছে।
প্রথমত: ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকদের দাবিই হচ্ছে এই সংশোধনীর কারণ। ব্যাংকিংখাতের
সামগ্রিকি উন্নতি, স্বচ্ছতা বা আমানতকারীদের স্বার্থের বিষয়গুলো এখানে গৌণ বা বিবেচিতই
হয়নি। দ্বিতীয়ত: আইন অনুযায়ী ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকরা হবেন আমানতকারীদের আমানতের
রক্ষক হিসাবে জনসেবক, ব্যাংকের মালিক নন। বাস্তবেও ব্যাংকের সম্পদের সিংহভাগই হচ্ছে
আমানতকারীদের আমানত এবং তাতে উদ্যোক্তা পরিচালকদের অংশ সামান্যই। কিন্তু, আমানতকারীদের পক্ষ থেকে কোনধরণের সুরক্ষামূলক সংশোধনীর দাবি ছিল না। তৃতীয়ত: পরিচালকরা
যে বেআইনীভাবে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ঋণ ও অন্যান্য অনৈতিক সুবিধা দিয়ে
আমানতকারীদের স্বার্থ ক্ষুন্ন করছেন এবং খেলাপিঋণের সংকটের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায়
নেই। এক্ষেত্রে সর্বসাম্প্রতিক ব্যাংকিং সংকটের কেন্দ্রে থাকা ফারমার্স ব্যাংক ও এনআরবি
গ্লোবাল ব্যাংকের বেআইনী কার্য্যক্রম ও অনিয়মগুলোর কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে।
এই দুই ব্যাংকে বেনামে শেয়ারধারণের অভিযোগেরও যে কার্য্যকর কোনো নিষ্পত্তি হয়েছে তাও
নয়। ঢাকা ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের একজন করে পরিচালক
অন্য ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়েও নিজ নিজ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সদস্যপদে বহাল আছেন
( ৩ ব্যাংক পরিচালক ঋণখেলাপি, প্রথম আলো, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৭)। দেশের শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপিদের
মধ্যেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিশেষ সুবিধা নিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম বাদ
দেওয়াতে সক্ষম হওয়ায় তাঁদেরও নিজ নিজ ব্যাংকে পরিচালকের পদ অক্ষত আছে।
সরকার এসব ব্যাংক পরিচালকদের দাবিকেই বিবেচনায় নিয়েছে।
ব্যাংক পরিচালকদের একটি সংগঠন আছে – বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস। সময়ে সময়ে এই অ্যাসোসিয়েশন সামাজিক
দায়বদ্ধতা কার্য্যক্রমের আওতায় বিভিন্ন উদ্যোগে উদারহস্তে দান করে থাকে। এবছরেই অগাষ্ট
মাসের ২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে
৮৫ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছেন বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা। এর আগে গত ১৫ মে প্রধানমন্ত্রীর
হাতে ১৩৬ কোটি ২০ লাখ টাকার চেক তুলে দেন ব্যাংকের চেয়ারম্যানরা। এর মধ্যে ৫৭ কোটি
৪৫ লাখ টাকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্টে, ৫০ কোটি ২৫ লাখ প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাষ্টে
এবং ২৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা সূচনা ফাউন্ডেশনে দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে
এর আগেও বেসরকারী ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে বড় অংকের সহায়তা দেওয়া হয়।
ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের
অধ্যাপক শাহজাদ উদ্দিন এবং ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেষ্টারের সিনিয়র লেকচারার জাভেদ সিদ্দিকী
বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্য্যক্রমের ওপর একটি গবেষণা করেন। তাঁরা
২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এসব ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য এবং সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন
বিশ্লেষণ করে বলেন যে বাংলাদেশে ব্যাংকগুলো সমাজের প্রতি দায়িত্বপালনের সামাজিক কার্য্রক্রমের
নামে মূলত ক্ষমতাসীনদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে (সোশাল রেসপনসিবিলিটি মিনস
লয়ালটি টু দি রুলিং ফ্যামিলি ফর ব্যাংকস ইন বাংলাদেশ, ১ ডিসেম্বর, ২০১৬, দ্য ওয়্যার,ইন।
ব্রিটেনের দ্য কনভারসেশন এই নিবন্ধটি প্রকাশ করে তারও দুদিন আগে।)
আগামীবছরের শুরুতেই জাতীয় সংসদ অধিবেশনে
বসবে। ব্যাংকিং কোম্পানি সংশোধনী আইনটি গত অধিবেশনেই পাশ হবে বলে ব্যাংক পরিচালকরা
আশা করেছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি শুরুতে এই সংশোধনীর বিরোধীতা
করলেও গত অধিবেশনে নাটকীয়ভাবে তাঁরা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। ফলে, আগামী অধিবেশনে বিলটি
ফেরত আসার সম্ভাবনা যথেষ্ট। তবে, ফারমার্স ব্যাংক এবং এনআরবি
গ্লোবাল ব্যাংকের কেলেংকারি প্রকাশের পর এখন এই সংশোধনীর সম্ভাব্য বিপদ আরও স্পষ্ট
হয়েছে। এখন কি সরকার আমানতকারীদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এই ক্ষতিকর আইন তৈরি থেকে
পিছিয়ে আসবে? কেননা, এখনতো প্রয়োজন বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ, সংশোধন নয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন