সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

‘ম‘-তে শুধু মাহাথির নয়, মারদেকাও !


মালয়েশিয়ায় ৬১ বছরের মধ্যে এই প্রথম ক্ষমতার ব্যালটের মাধ্যমে পালাবদল ঘটার বিষয়টি বিশ্বের যেকোন প্রান্তের গণতন্ত্রমনা মানুষের জন্য সুখবর, আনন্দ প্রকাশের এবং অবশ্য-উদযাপনীয় সাফল্য। আপাতদৃশ্যে অবশ্য যে প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে তাতে অবসরজীবন থেকে রাজনীতিতে ফিরে আসা মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বের প্রতি একধরণের মোহাচ্ছন্নতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের নিরিখে এই নির্বাচনী চমকের এক অতি সরল ব্যাখ্যার এক ভুল প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সাফল্য অবশ্যই উদযাপনীয়; তবে, তা শুধুমাত্র মাহাথির মোহাম্মদের নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের নজির সৃষ্টির জন্য নয়। বরং, দক্ষিণ-র্পূব এশিয়ার একটি উদীয়মান অর্থনীতির গণতন্ত্রায়ণের জন্যই এই নির্বাচনী ফলাফলকে সাধুবাদ জানানো প্রয়োজন।
৯২ বছরের এক বৃদ্ধের রাজনীতিতে নাটকীয়ভাবে ফিরে আসা প্রবীণ এবং অবসর নেওয়া রাজনীতিকদের জন্য যে অনুপ্রেরণার বিষয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু, এই নির্বাচনের সাফল্যগুলোর মধ্যে তার চেয়েও  তাৎপর্য্যের এবং গুরুত্বর্পূণ আরও অনেক বিষয়ই রয়েছে।
মালয়েশিয়ার এক তরুণ সাংবাদিক সামান্থা ট্যান, সবাই তাকে স্যাম বলেই ডাকে। স্যাম বিরোধীজোটের বিজয়ের প্রতিক্রিয়ায় বললো এ হচ্ছে মারদেকা। মারদেকা হচ্ছে মালয়ভাষায় মুক্তি বা স্বাধীনতা। উপনিবেশ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর এই প্রথম মালয়েশিয়া ক্ষমতায় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাত থেকে যে মুক্তি পেলো সেটাই এই নির্বাচনের প্রথম ও প্রধান প্রাপ্তি।
দ্বিতীয়ত: প্রমাণ হলো যে বিরোধীদল গ্রহণযোগ্য বিকল্প রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে পারলে ভোটাররা তাদেরকে সুযোগ দেয়। মালয়েশিয়া যে ধারায় চলে আসছিলো তা হচ্ছে মাহাথির মোহাম্মদের তৈরি শক্তহাতের শাসনব্যবস্থা। মাহাথির ছিলেন কথিত প্রজাহিতৈষী স্বৈরশাসক বা বেনোভোলেন্ট ডিক্টেটর। তাঁর উত্তরসূরিদেরও সেভাবেই দীক্ষা দিয়েছেন তিনি। সেখানে শাসকের কথাই আইন এবং তার বিরোধীতার পরিণতি হচ্ছে সীমাহীন দূর্ভোগ যার সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হলেন তাঁর এককালের ডেপুটি আনওয়ার ইব্রাহিম।ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর কঠোর নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে তাঁর রেকর্ড সামরিকশাসকদের সঙ্গে তুলনীয়। এবারের নির্বাচনে মাহাথির তাঁর সেই লৌহমানবীয় শাসনব্যবস্থার ভুল স্বীকার করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছেন। ভোটাররা সেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ দিয়েছে বিরোধী জোটকে।
তৃতীয়ত: মাহাথিরের নেতৃত্বাধীন জোট পাকাতান হারাপানের নির্বাচনী অঙ্গীকার করেছে মালয়েশিয়াকে দূর্নীতিমুক্ত করবে। পানামা পেপারসের কথা হয়তো আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট আইসিআইজে (ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম) বিশ্বের কয়েক ডজন রাজনীতিকের করমুক্ত দ্বীপরাজ্যে (অফশোর) সম্পদ জমা রাখার যে কেলেংকারি ফাঁস করেছিল তাতে প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজ্জাকের ছেলের নামে ৭৫ কোটি ডলারের বেশি সম্পদের খবর মেলে। কিন্তু, অভ্যন্তরীণ তদন্তে তা নাকচ করা হলেও একাধিক আর্ন্তজাতিক তদন্তে তিনি নানাভাবে বাধা দিয়ে চলেছেন। এই দূর্নীতির অভিযোগও নির্বাচনে বড়ধরণের প্রভাব ফেলেছে।
চর্তূথত:, বিরোধী জোট গঠনে পূবশত্রুতা ভুলে গিয়ে মাহাথির মোহাম্মদ ও আনওয়ার ইব্রাহিমের দলের সমঝোতা সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরণের আস্থার জন্ম দিয়েছে। মাহাথির তাঁর নিজের দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) ছেড়েছেন মাত্র বছর দুয়েক আগে ২০১৬ সালে। কোনো নতুন দল গড়েন নি, আনওয়ারের নেতৃত্বাধীন দল এবং অন্য তিনটি দলের আশার জোটপাকাতান হারাপানে যোগ দিয়ে মানুষের মধ্যে আশা জাগিয়েছেন ।
পঞ্চমত: বিরোধীদের এই নির্বাচনী সাফল্যে আনওয়ার ইব্রাহিমের প্রতি ভোটারদের সহানুভূতি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। ২০১৩র নির্বাচনে মোট ভোটের হিসাবে আনওয়ারের নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতাসীন জোটের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও পেলেও পার্লামেন্টের আসনসংখ্যায় পিছিয়ে থাকায় সেবার সরকারগঠনের সুযোগ পায়নি। বরং, তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর রাজনৈতিক গুরু মাহাথিরের আমলে দায়ের হওয়া সমকামিতার মামলার শুনানি ত্বরান্বিত হয়েছে এবং তাঁকে জেলে যেতে হয়েছে। আনওয়ারের স্ত্রী বিরোধীনেত্রী হিসাবে দায়িত্বপালনের সময়ে তাঁর স্বামীর প্রতি মানুষের সহানুভূতি জাগাতে সক্ষম হয়েছেন বলে ধরে ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না।
ষষ্ঠত: বিজয়ের পর মাহাথির এক থেকে সর্বে্বাচ্চ দুই বছরের বেশি ক্ষমতায় থাকবেন না এবং দায়িত্ব জোটের অন্য কারো ( সম্ভবত আনওয়ার) র কাছে হস্তান্তর করবেন বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন তাতে ইঙ্গিত মেলে তিনি নেজেও বদলে গেছেন। অতীতের ভুল স্বীকার করে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির ধারা পরিত্যাগে তিনি তৈরি আছেন।
সপ্তমত: মানুষ একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেয়েছে। টানা বাষট্টি বছর ক্ষমতায় একই দলের একই রাজনীতিতে ক্লান্তি ও বিরক্তি তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং, সত্যিকারের পরিবর্তনের সম্ভাবনায় বিশেষ করে তরূণ ভোটাররা বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছে বলেই ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
মালয়েশিয়ার আরেক প্রধানমন্ত্রী আব্দুল্লা বাদাওয়ির কথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। ২০০৩ সালে মাহাথির প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর তাঁর দায়িত্বভার দিয়েছিলে আব্দুল্লা বাদাওয়ির ওপর। কিন্তু, বাদাওয়ির ওপর ভরসা রাখতে পারেন নি বেশিদিন। পেছন থেকে সুতার টানে পালাবদল ঘটিয়ে নাজিব রাজ্জাককে খ্ষমতায় বসিয়েছেন ২০০৯ সালে। কিন্তু, বছরখানেকের মধ্যেই নাজিবের সঙ্গে তাঁর বিরোধ দেখা দেয়। তবে, ২০১৬ পর্যন্ত তিনি ইউএমএনও ছাড়েনি নি। কর্তৃত্ববাদি অভ্যাস তিনি কতটা ছাড়তে পেরেছেন তা  দেখার জন্য এখন আমাদের অপেক্ষার পালা। তবে, জনগণ যেহেতু ভোটের শক্তি ও তাতে মুক্তির স্বাদ একবার পেয়েছে সেহেতু প্রজাহিতৈষী স্বৈরশাসনের পথে ফেরাটা আর সহজ হবে না।
( ১১ এপ্রিল, ২০১৮তে প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের বিশ্লেষণ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি ও রাজনৈতিক সংকট

  দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে প্রধানত: দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে – একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্লাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।  আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত:  সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্লাটফর্ম – বাংলাদেশে এটি ফেসবুক এবং ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্...