ভারত এবং বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন যে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে
তাতে উভয়দেশের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্বের যে কোনো সফরই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। সুতরাং,
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পশ্চিমবঙ্গ সফরও যে একইধরণের তাৎপর্য্য বহন করবে সেটাই স্বাভাবিক।
যদিও এটি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সফর নয়, কিন্তু সফরের যে প্রধান উদ্দেশ্য – দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের
দুটি বিশেষ আয়োজন তার একটিতে আচার্য্য হিসাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও
উপস্থিত ছিলেন। আর, দুই দেশের, বিশেষ করে বন্ধুরাষ্ট্রের দুই নেতার মধ্যে দেখা হবে,
অথচ একান্ত আলোচনা হবে না এমনটি ধারণারও অতীত।
আলোচনার বিবরণ অবশ্য বাংলাদেশ বা ভারত – কোনো তরফেই
সরকারীভাবে প্রকাশ করা হয় নি। কোলকাতার বাংলা কাগজ আনন্দবাজার অবশ্য জানিয়েছে ‘‘শুক্রবার বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধনের পরে সেখানেই মোদীর
সঙ্গে বৈঠকে হাসিনা জানিয়েছেন— তাঁর
সরকার উত্তর-পূর্বের জঙ্গিদের দেশছাড়া করেছে, ট্রানজিট দিয়েছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে বরাবর
দিল্লির পাশে থেকেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনের বছরে এ বার তাই ভারতের সহযোগিতা চাই।‘‘ পত্রিকাটি আরও লিখেছে ‘‘তাঁর
দফতরের এক সূত্র জানান, হাসিনার বার্তা— মুক্তিযুদ্ধের
শক্তিকে সরাতে, বাংলাদেশকে ফের পাকিস্তান বানানোর চক্রান্ত চলছে। আওয়ামী লিগ ক্ষমতা
হারালে পশ্চিমে আর পূবে— দু’দিকেই পাকিস্তান নিয়ে ঘর করতে হবে ভারতকে। তাই ভারতের
উচিত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারই যাতে ক্ষমতায় ফেরে, সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা
করা।‘‘
আনন্দবাজার যেভাবে লিখেছে আলোচনায়
সেরকম কথাবার্তা হয়েছে কিনা আশা করি সরকার তা অচিরেই স্পষ্ট করবেন। বাংলাদেশের আগামী
নির্বাচনে প্রতিবেশিদের আগ্রহ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। বাইরের অনেক দেশেরই আগ্রহ আছে।
ক্ষমতায় রদবদল হলে সম্পর্ক ঝালাই করে নেওয়ার প্রয়োজন হয় বলেই এধরণের আগ্রহ তৈরি হয়।
তবে, শীর্ষবৈঠকের আগে বিশ্বভারতীর যে অনুষ্ঠান দূরদর্শনে সরাসরি সম্প্রচার করেছে তাতে
আমরা দেখেছি প্রধানমন্ত্রী মোদি স্পষ্ট করেই বলেছেন ২০৪১ সালের মধ্যে নিজেদেরকে উন্নত
দেশে উত্তরণ ঘটাতে শেখ হাসিনার স্বপ্ন বা দৃশ্যকল্প ( ভিশন) বাস্তবায়নে ভারত তাঁকে
র্পূণ সমর্থন দেবে। এতো জোরালো প্রকাশ্য আশ্বাসের পর নির্বাচনের জন্য আলাদা করে সহায়তা
চাওয়ার আর অবকাশ থাকে কি?
ভারতের বেসরকারী একটি টিভি চ্যানেল এনডিটিভি লিখেছে দুই প্রধানমন্ত্রী
শান্তিনিকেতনে একই মঞ্চে চার ঘন্টা সময় কাটালেও তাঁরা দুটো গুরুত্বর্পূণ বিষয়ে নীরব
ছিলেন। এই নীরবতাই সবচেয়ে জোরালো ছিল (ইন দ্য এন্ড , সাইলেন্স স্পোক দ্য লাউডেস্ট)।
তাঁদের কথায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তার ‘টি‘ শব্দটি যেমন
উচ্চারণ করেনি নি, তেমনই প্রধানমন্ত্রী মোদি রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে ছিলেন নীরব।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন ষোলো কোটি মানুষের বাংলাদেশে এগারো লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।
তারা যখন এসেছে তখন আমরা আমাদের সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছি। আমরা চাই
রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন হোক। মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে
হবে। আমাদের উভয় দেশকেই এদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রী
মোদি তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতায় বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে আটশো কোটি ডলার ঋণ সহায়তা
দেওয় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আরও বিদ্যূৎ দেওয়ার কথা বললেও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে
কোনো কথা বলেন নি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এসব শিরোনামের কোনোকিছুই বাংলাদেশের গণমাধ্যমে
তেমন একটা প্রাধান্য পায় নি। ধারণা করি, সরকারী ভাষ্য না পাওয়ার কারণেই আমাদের এই দৈন্যতা।
কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী মোদির ২০৪১‘র স্বপ্ন
বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থনের খবরটি সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার
তথ্য? এই আশ্বাসের গুরুত্ব বুঝতে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
সংবাদমাধ্যমে অন্য আরেকটি বিষয়ও উপেক্ষিত হয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী
রাজনীতির পুর্ণজাগরণের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে বিশ্বভারতীর অনুষ্ঠানে
অতিথি সরকারপ্রধানের ভাষণের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির
রাহমানির রাহিম‘ উচ্চারণ। ভারতের সাম্প্রতিক মুসলিমবিদ্বেষী আবহের
পটভূমিতে এটি কি বিশেষ কোনো বার্তা বহন করে? এসব বলা ও না-বলা কথা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের
রসায়ন অনুধাবনে খুবই গুরুত্বর্পূণ।
(২৬মে, ২০১৮তে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত বিশ্লেষণ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন