একটা ধাঁধা দিয়ে শুরু করি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় দ্রততম দৌড়বিদের জন্ম কোন দেশে? পরিধিটা যদি আরও কমিয়ে এনে বলি সবচেয়ে বেশি দ্রুততম ম্যারাথনার কোন দেশের? উত্তরটা আমি বলবো আরও পরে। তবে, একটা ইঙ্গিত দিয়ে রাখি। দেশটির আরেকটি পরিচয় হচ্ছে‘মানবজাতির দোলনা‘। আদিমানুষের স্মারকচিহ্ন ওই দেশটিতেই পাওয়া গেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত।
দেশটি স্বাধীন হয়েছে আমাদের চেয়ে মাত্র সাত বছর আগে। আয়তনে আমাদের চেয়ে প্রায় দশগুণ বড়, কিন্তু জনসংখ্যা আমাদের তিন-ভাগের এক ভাগ। নির্বাচনী গণতন্ত্রে যাত্রা আমাদের মতই ১৯৯২ সালে। নির্বাচন নিয়ে প্রতিদ্বন্দিতা আমাদের মতই রক্তক্ষয়ী। ২০০৭, ২০১৩ এবং ২০১৭ –এই তিনটি নির্বাচনের একটিও প্রাণহানি এবং রক্তক্ষয়ী সহিংসতা থেকে মুক্ত থাকেনি। এরমধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি নির্বাচনে ২০০৭ এ নিহত হয়েছিলেন তেরোশ‘রও বেশি , আহত পাঁচ হাজারেরও বেশি । আর, অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা লক্ষাধিক। রাষ্ট্রকাঠামোয় ক্ষমতার ভারসাম্য আনার চেষ্টায় ২০১০ সালে সংবিধান সংশোধনেও সেই রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দিতার অবসান ঘটেনি। ২০১৩ এবং ২০১৭‘র নির্বাচনেও পুনরাবৃত্তি ঘটেছে, তবে প্রাণহানির সংখ্যা কমেছে। ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দিতায় একদিকে দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতার উত্তরাধিকারী, অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সহযোদ্ধা। খৃষ্টানপ্রধান ওই দেশটিতেও ইসলামী সন্ত্রাসবাদ একটি বড় হুমকি যার সূচনা ঘটে ১৯৯৮ সালে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের হামলায় যাতে ২২৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
২০১৭‘র নির্বাচনে ব্যপক অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগে দেশটির সুপ্রিম কোর্ট পুননির্বাচনের আদেশ দিলে দুইমাসের ব্যবধানে নতুন করে ভোটগ্রহণ করা হয়। কিন্তু, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের প্রতিদ্বন্দী পুনর্নিবাচন বয়কট করেন। ফলে,বাতিল হওয়া নির্বাচনে ৫৪ শতাংশ ভোট পাওয়া প্রেসিডেন্ট পুনর্নিবাচনে পান ৯৮ শতাংশ ভোট। তবে, বয়কটের কারণে ভোট পড়ার হার আগের ৭৯.৫ শতাংশ থেকে কমে নেমে আসে মাত্র আটত্রিশ শতাংশে। ফলে, বৈধতার সংকটে থাকা পুর্ননির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এর শপথগ্রহণের দিন তাঁর প্রতিদ্বন্দীর জন্য আয়োজিত হয় জণগনের প্রেসিডেন্টের পাল্টা অভিষেক।দেশটিতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় বিরোধীদল এবং ভিন্নমতের অনুসারীদের ওপর দমন অভিযান। বন্ধ করে দেওয়া হয় কয়েকটি বেসরকারী টিভি চ্যানেল এবং সংবাদপত্র।
দুদিন আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারে বেয়াড়া আচরণে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁদের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন। এর আগে, গত ৯ মার্চ তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দীর সঙ্গে জাতীয় আপোষরফার লক্ষ্যে এক সমঝোতায় পৌঁছেছেন। এপ্রিলের শেষসপ্তাহে দুই নেতা চৌদ্দজন উপদেষ্টাকে জাতীয় সংলাপের জন্য উপদেষ্টা হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছেন।
আমার বিশ্বাস ধাঁধার উত্তরটি সবাই ধরতে পেরেছেন। তবুও, আলোচনার সুবিধার জন্য নামটি নির্দিষ্ট করাই ভালো। র্পূব আফ্রিকার দেশ কেনিয়ার ওই দুই প্রতিদ্বন্দী রাজনীতিক হলেন প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা এবং রাইলা ওদিঙ্গা। উহুরু কেনিয়াত্তার বাবা ছিলেন দেশটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট জোমো কেনিয়াত্তা। রাইলা ওদিঙ্গা ছিলেন জোমো কেনিয়াত্তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট। কিন্তু, স্বাধীনতার পর ষাটের দশকেই তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় এবং ওদিঙ্গা নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন। ২০১৩ এবং ২০১৭‘র নির্বাচনে জোমোর পুত্র উহুরু কেনিয়াত্তার সঙ্গে এই দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছায়। গোত্রকেন্দ্রিক রাজনৈতিক মেরুকরণে অভ্যস্ত দেশটিতে গত কয়েক দশক ধরেই রাজনীতি মূলত দুটি পরিবারকেন্দ্রিক রেষারেষির বৃত্তে আবদ্ধ।
প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তা ও রাইলা ওদিঙ্গার মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা এবারই প্রথম তা নয়। এর আগেও একাধিকবার তাঁরা সমঝোতা করেছেন, আবার নির্বাচনের সময়ে প্রতিদ্বন্দিতা সহিংসতায় গড়িয়েছে। সুতরাং, এবারও তাঁদের সমঝোতার ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা আর উদ্বেগ রয়েই গেছে। তবে, এবারই প্রথম প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্তা সবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা মেনে নিয়েছেন ‘ক্ষমতার পুরোটাই অথবা অর্ন্তভূক্তিমূলক কিছুই না‘ এই লক্ষ্য অর্জনের প্রতিদ্বন্দিতা নির্বাচনগুলোকে জীবন, অর্থনীতি এবং জাতীয় মর্যাদার প্রতি হুমকিতে রুপান্তরিত করেছে। আর্ন্তজাতিক রাজনীতির গতিবিধি বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করার জন্য সুপরিচিত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ(আইসিজি) এই সমঝোতায় আশার আলো দেখছে। আইসিজি বলছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণ ও অর্ন্তভুক্তিমূলক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সহিংসতার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত – বিশেষত পুলিশের শক্তিপ্রয়োগের বিষয়ে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষার মত বিষয়গুলোর ওপর এই সমঝোতার ভবিষ্যত নির্ভরশীল। দ্রুততম সময়ে রাজনৈতিক সংকট মোচনের দৌড়েও কেনিয়া নজির স্থাপন করবে এমন প্রত্যাশা তাই খুবই স্বাভাবিক।
২.
সপ্তাহ দুয়েক আগে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের নেতৃত্বে গঠিত এলএসই-অক্সর্ফোড কমিশন অন স্টেট ফ্র্যাজিলিটিরি একটি সুপারিশের কথা লিখেছিলাম (গণতন্ত্র রপ্তানির বিষয় নয়, প্রথম আলো, ২৬ এপ্রিল, ২০১৮)। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) এবং অক্সর্ফোড ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন এবং স্টানর্ফোড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক এবং উন্নয়ন তহবিলের ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত ওই কমিশনের সুপারিশ হচ্ছে দূর্বল বা ঠুনকো গণতন্ত্রে প্রয়োজনে নির্বাচন বিলম্বিত করে প্রতিদ্বন্দীদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। কেনিয়ার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীদের সমঝোতা এবং ক্ষমতাকাঠমোয় সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় সংলাপের উদ্যোগ আর ক্যামেরন কমিশনের সুপারিশ ঘোষণার আগেই শুরু হলেও এই দুয়ের মধ্যে প্রচুর মিল দৃশ্যমান। তাছাড়া, কমিশন যে চৌদ্দটি দেশের ওপর গবেষণা চালিয়েছে কেনিয়া সেই তালিকায় নেই। ধারণা করা যায়, কেনিয়ার উদ্যোগ সফল হলে ভবিষ্যতে দূর্বল গণতন্ত্রগুলোর সমস্যা মোকাবেলায় রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে সংস্কার তত্ত্বের প্রতি আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন বাড়বে।
কমিশন অন স্টেট ফ্র্যাজিলিটির সুপারিশের বিষয়ে সোশাল মিডিয়ায় কয়েকজন বন্ধু বেশ কিছু গুরুত্বর্পূণ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। প্রতিদ্বন্দীদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিকে ষড়যন্ত্রমূলক অভিহিত করে তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি বেছে নেওয়ার অধিকারের কোনো বিকল্প গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে নির্বাচনের যে কোনো বিকল্প নেই সেপ্রশ্নে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই। কমিশন কিন্তু তার সুপারিশে গণতন্ত্র সংহত করায় বহুদলীয় নির্বাচনকে উৎসাহিত করার কথেই বলেছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কিম্বা সময়সীমার চাপ বিবেচনায় নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক না হয়ে একতরফা, জালিয়াতির্পূণ কিম্বা কেন্দ্র দখলের লড়াইয়ে পরিণত হয় তাহলে তা যে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার বদলে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
কমিশন বলেছে সুশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ – যেমন স্বাধীন বিচারবিভাগ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দূর্নীতি দমন কমিশন গড়ে তোলা ও সেগুলোর সক্ষমতা তৈরি ছাড়া ঠুনকো গণতন্ত্রে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী পক্ষের সব কিছু নিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ (উইনার টেকস অল) অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ।
৩.
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে সংহত করতে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং সেগুলোর সামর্থ্য ও সক্ষমতা বাড়াতে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাই হয়েছে। প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দীর মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতারও একাধিক নজির আছে। প্রথম দফা সমঝোতায় রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটে সংসদীয় গণতন্ত্রে। এরপর নির্বাচনব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনের পরিণতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালুর বিষয়ে সমঝোতা। কিন্তু, আদর্শ নির্বাচনব্যবস্থা হিসাবে কোনো কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। বরং, অপেক্ষাকৃত সফল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আওয়ামী লীগই বাতিল করে দিয়েছে।
সরকারের দাবি নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু, বর্তমান সরকারের নয়বছরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে গ্রহণযোগ্য মানসম্পন্ন নির্বাচনের নজির বিরল। প্রবীণ সাংবাদিক-গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন ‘কারচুপির সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে আরেক উপসর্গ। স্থানবিশেষে নির্বাচনটাকেই শিকেয় তুলে রাখা। নির্বাচিত হওয়ার পর কাজ করতে না দেওয়ার চেয়ে যেখানে বিরোধী দলের বিজয়ের সম্ভাবনা এবং সরকারি দলের প্রার্থীর পরাজয় অবধারিত, সেখানে ঠুনকো অজুহাতে নির্বাচন স্থগিত রাখা অতি বুদ্ধিমানের কাজ‘ (যে চালাকি সবাই বোঝে, প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল, ২০১৮)। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন স্থগিত হওয়ার পটভূমিতেই তাঁর এই মন্তব্য।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ আমাদের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। সেই হিসাবে সময় আছে মাত্র সাত মাসের মত। জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে ক্ষমতাসীর দলের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি আলোচনার দাবি জানালেও আপাতদৃশ্যে সরকার কোনোধরণের সংলাপে বসতে নারাজ। বিএনপির নেতারা তাঁদের সাম্প্রতিকতম সাংগঠনিক সভার পর বলেছেন তাঁরা তাঁদের দলীয়প্রধানকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যাবেন না। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েও তাঁদের নির্দিষ্ট দাবি আছে, যদিও তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। সরকারসমর্থকরা ২০১৪‘র একতরফা নির্বাচন বয়কটের জন্য বিএনপিকে অব্যাহতভাবে দুষে চলেছেন। কিন্তু, বাস্তবতা হচ্ছে সেই নির্বাচনে সরকারের সঙ্গীরা ছাড়া প্রচলিত দলগুলোর কোনোটিই অংশ নেয়নি। আগামী নির্বাচনেও একইধরণের বয়কটের পুনরাবৃত্তি হলে সংকটটা আওয়ামী লীগের জন্য কি সুখকর হবে?
( দৈনিক প্রথম আলোয় ১০ মে, ২০১৮তে প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন