যে কোনো প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সশস্ত্র রাষ্ট্রীয়বাহিনীর গুলিতে ৬০ জনের
মৃত্যু ঘটলে তাকে ‘নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ‘ ছাড়া অন্যকোনোভাবে
বর্ণনা করা হয়েছে এমন নজির বিরল। কিন্তু, বিশ্বের র্দীঘতম বেআইনী দখলদারিত্বের অধীনে
অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনীদের ওপর ইজরায়েল যে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালালো তার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বনেতাদের
মধ্যে তেমন একটা ঝাঁঝ নেই। কেননা, ফিলিস্তিনীদের জীবনের কোনো দাম নেই। তার ওপর সেই
ফিলিস্তিনীরা যদি গাযার অধিবাসী হন তাহলে সেই জীবনের দাম আরও কম। কেননা, তারা গণতান্ত্রিক
নির্বাচনে হামাসকে বেছে নিয়েছিল। এর আগে হামাসে দুবার ইজরায়েলী সেনাদের অভিযানে কয়েকশ
নারী-শিশুসহ সাধারণ ফিলিস্তিনীর মৃত্যুতেও বিশ্বনেতারা শুধু শোক আর উদ্বেগ প্রকাশ করেই
দায় সেরেছেন। সবাই মিলে অশান্তির দায় চাপিয়েছেন হামাসের ওপর।
সত্তুর বছর আগে ১৯৪৮ এর ১৫ মে ফিলিস্তিনীদের নিজভূমি থেকে উচ্ছেদ
করে এবং তাড়িয়ে দিয়ে যে ইজরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, তার সত্তুরতম বার্ষিকী উদযাপনের
দিনে ওই বিতাড়িত ফিলিস্তিনীদের প্রতিবাদ জানানোর অধিকার স্বীকার করতেও এসব নেতাদের
অনেকে রাজি নন। ওই দিনটি যে ফিলিস্তিনীদের মহাদূর্যোগের দিন ‘নাকাবা‘
সেটি
স্মরণ করাও তাদের অপরাধ। সেকারণেই ইজরায়েলের সুরে সুর মিলিয়ে অনেকেরই অভিযোগ হামাসের
বিরুদ্ধে। ইজরায়েল রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর মুখপত্ররা রোবটের মত একইকথা বলে চলেছেন যে
হামাস নারী-শিশু ও নিরীহ নাগরিকদেরকে মানবঢাল হিসাবে তাদের নিরাপত্তা বেষ্টনি ছিন্ন
করতে পাঠিয়েছে। হামাসের ‘সন্ত্রাসী‘রা ককটেল-বোমা
নিয়ে ইজরায়েলীদের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। এর চেয়েও নিষ্ঠুর এবং
করুণ হচ্ছে এসব হত্যাকান্ডের শিকার যাঁরা তাঁদেরকেই তাঁদের মৃত্যুর জন্য দায়ী করায়
ইজরায়েলীদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইজরায়েলের বন্ধুরা। যুক্তরাষ্ট্রের
স্থায়ী প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদে ইজরায়েলের সংযমের প্রশংসা করে বলেছেন অন্য যেকোনো
দেশ এই পরিস্থিতিতে যা করতো, ইজরায়েল তার চেয়ে অনেক বেশি সংযত ছিল। ব্রিটেনের স্থায়ী
প্রতিনিধি ফিলিস্তিনীদের শান্তির্পূণ প্রতিবাদের অধিকার রয়েছে বলার পর হামাসের ভূমিকাও
তদন্তের কথা বলেছেন।
পশ্চিমা গণমাধ্যমের আচরণও
খুব একটা আলাদা নয়। টেলিভিশনের পর্দা চালু করলেই দেখা যাচ্ছে নানাভাবে এই হত্যাকান্ডের
সাফাই দেওয়ার চেষ্টা। নিহতদের ছবি প্রচার-প্রকাশে গণমাধ্যমগুলো বোধগম্য কারণে কিছুটা
সাবধানতা মেনে চলে সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু, সহিংসতার বীভৎসতার চিত্র উধাও করে
দিয়ে দখলদার ইজরায়েল রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনীর মুখপত্রদের বারবার হত্যাকান্ডের যৌক্তিকতা
প্রমাণের সুযোগ করে দেওয়া রীতিমত একটা অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছেছে। তবে, সংবাদপত্রের পাতায়
কিছুটা ভিন্নচিত্র পাওয়া যাচ্ছে। নিউইর্য়ক টাইমস-এর এক নিবন্ধে একটা গুরুত্বর্পূণ ঐতিহাসিক
সত্যের উল্লেখ রয়েছে। পত্রিকাটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ১৯৪৮ সালে যখন ইজরায়েল স্বাধীনতা
ঘোষণা করে তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রৃম্যান দেশটিকে স্বীকৃতি
দিতে সময় নিয়েছিলেন মাত্র ১১ মিনিট। ওই স্বীকৃতিতে উজ্জীবিত হয়ে সদ্য সৃষ্ট ইজরায়েল
নিজেদেরকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে। পত্রিকাটি বলছে সত্তুর বছর পরে
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প র্পূব জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস সরিয়ে আনায় ইজরায়েলের
সগর্ব দম্ভের পাশাপাশি একধরণের বিপন্নতাবোধও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এতোদিনের অনুসৃত নীতি ছিল, র্পূব জেরুজালেমের ভবিষ্যত
নির্ধারিত হবে শান্তি সমঝোতায়। কিন্তু, সেই নীতি ছুঁড়ে ফেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরাসরি
বলেই দিয়েছেন র্পূব জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী মেনে নিয়েই ফিলিস্তিনীদের সমঝোতা
করতে হবে। ইজরায়েল এবং ফিলিস্তিনীদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় মধ্যস্থতার আর্ন্তজাতিক
যে স্বীকৃত উদ্যোগ মিডলইস্ট কোর্য়াটেট নামে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্র (রাশিয়া, ইউরোপীয়
ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ) তার গুরুত্বর্পূণ
অংশ। কিন্তু, এই পক্ষপাতের পর তার সেই ভূমিকার প্রতি আর কোনো আস্থার অবকাশ থাকে না।
ইজরায়েলের প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষপাতের এটিই একমাত্র ঘটনা
নয়। এর আগে, তারা ফিলিস্তিনী উদ্বাস্তুদের ত্রাণকাজের জন্য জাতিসংঘ সংস্থায় প্রতিশ্রুত
সাড়ে বারো কোটি ডলারের ছয় কোটি বরাদ্দ কমিয়ে দেয়। ইজরায়েলের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় রাজি
না হলে ওয়াশিংটনে ফিলিস্তিনী লিয়াজোঁ দপ্তর বন্ধ করে দেওয়ার হুমকির জবাবে প্রেসিডেন্ট
আব্বাস ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা করার পর ওই বরাদ্দের অর্ধেক প্রত্যাহার করা হয় গত
জানুয়ারিতে। এবছরেই ট্রাম্প প্রশাসন তার পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে
ইজরায়েলের দখলে থাকা ফিলিস্তিনী অঞ্চলের বর্ণনায় ‘অধিকৃত এলাকা‘
কথাটি
বাদ দেয়। এরপর ওয়াশিংটন স্পষ্ট করে বলেই দিয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্রের কথা না রাখলে ফিলিস্তিনীদের
ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হবে।
অথচ, বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সত্য হচ্ছে র্পূব জেরুজালেমে ইজরায়েলের
উপস্থিতি আর্ন্তজাতিক আইনে বেআইনী দখলদারি হিসাবে চিহ্ণিত। ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরায়েল
যুদ্ধের সময় তারা এটি দখল করে নেয়। আর, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনার যত আলোচনা গত
পাঁচ যুগ ধরে হয়ে এসেছে সেগুলোতে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার র্পূবশর্ত হিসাবে সাতষট্টি-র্পূব
অবস্থানে ইজরায়েলের পিছু হটার কথা বলা হয়েছে। ইজরায়েল একের পর এক অগণিত জাতিসংঘ প্রস্তাব
উপেক্ষা করে ৬৭‘র দখল করা
ফিলিস্তিনী ও আরব ভূমি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এরপর ১৯৮০ তে ইজরায়েল আবার র্পূব জেরুজালেমের
দখলীকৃত অংশকে ইজরায়েল সম্প্রসারিত অঞ্চল হিসাবে অধিগ্রহণের কথা ঘোষণা করে। ওই বেআইনী
অধিগ্রহণকে নিরাপত্তা পরিষদ (৩০ জুন, ১৯৮০, প্রস্তাব ৪৭৬) বাতিল বলে ঘোষণা করে। ইজরায়েলই হচ্ছে একমাত্র রাষ্ট্র
যার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব কার্য্যকর করার ক্ষেত্রে বিশ্বশক্তিগুলো নির্বিকার
অথবা অসহায়।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থানান্তর
করবেন এই ঘোষণা বেশ কয়েকমাস আগেই দিয়েছিলেন। কিন্তু, তা এতোদিন করা হয়নি। ইজরায়েলীদের
স্বাধীনতার সত্তুরতম বার্ষিকী উদযাপনের উপলক্ষ্যকে দূতাবাসের ফলক উন্মোচনের জন্য বেছে
নেওয়া তাই আলাদা তাৎপর্য্য বহন করে সন্দেহ নেই। নাকাবা দিবসের প্রতিবাদ কর্মসূচি একদিন
এগিয়ে এনে ফিলিস্তিনীরা এটাই জানাতে চেয়েছে যে জেরুজালেমের অবৈধ দখলদারি তাদের পক্ষে
কখনোই মানা সম্ভব নয়।
২০০৭ সালে আরোপ করা অবরোধের যন্ত্রণা গাযার প্রায় কুড়ি লাখ ফিলিস্তিনীর
জীবনকে দু:সহ করে তুললেও তাদের প্রাণশক্তি, লড়াইয়ের মনোবল এখনও যে নি:শেষ হয়ে যায়নি
তার প্রমাণ তারা সময়ে সময়ে দিয়ে চলেছে। জাতি হিসাবে ফিলিস্তিনীরা ‘মরিয়া প্রমাণ
করে যে সে মরে নাই‘। এবারেও ষাটজন
স্বজনকে সমাহিত করে তারা বিশ্বকে জানান দিয়েছে যে সমস্যার মূল হচ্ছে বেআইনী দখলদারি
এবং তার অবসান ছাড়া শান্তির কথা অর্থহীন। গাযায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হামাসের
বৈধতা অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রের ওবামা প্রশাসন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে শান্তিপ্রক্রিয়ার
শরিক হিসাবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু, ইজরায়েলের কট্টর ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু
ওবামা প্রশাসনের কথা শোনেন নি। এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওবামাবিদ্বেষের মধ্যে নেতানিয়াহু
তাঁর আসল ত্রাণকর্তাকে খুঁজে পেয়েছেন। তবে, ফিলিস্তিনীদের মধ্যে এখন আর কেউ নেই যিনি
হামাসের বদলে ইজরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্য শরীক হতে পারেন।
বিপরীতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একলাচলার নীতি যে ক্রমশই তাকে নি:সঙ্গ
করে ফেলছে জেরুজালেম নীতির ক্ষেত্রে তা আবারও স্পষ্ট হয়েছে। জেরুজালেমে দূতাবাসের ফলক
উন্মোচন অনুষ্ঠানে ব্রিটেন, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ইউরোপীয় কূটনীতিকদের অনুপস্থিতি
তার এক নতুন নজির। ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের মতই ফিলিস্তিনী হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে
নিরাপত্তা পরিষদে কাউকে পাশে পায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তবে, ইজরায়েল –ফিলিস্তিনী
সংকটেও ইরানের ভূমিকা একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ফিলিস্তিনীদের প্রতি বিশেষ করে
হামাসের প্রতি ইরানের আর্থিক সহায়তা বন্ধে মরিয়া ইজরায়েল সুযোগটিকে ভালোভাবেই কাজে
লাগাচ্ছে। ইরানকে শায়েস্তা করতে ইজরায়েলের মত যুক্তরাষ্ট্রের পাশে আছে সউদি আরব। তবে,
র্পূব জেরুজালেম প্রশ্নে সউদি আরব অনেকটাই অসহায়। পবিত্র মসজিদ আল-আকসার সঙ্গে সারা
বিশ্বের মুসলমানদের আবেগের প্রশ্ন জড়িত। সেই আল-আকসার নিয়ন্ত্রণ ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন
হওয়ার প্রশ্নটি সউদি শাসকদের জন্যও একটি বড় পরীক্ষা।
সন্দেহ নেই ইরান এবং ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে ইজরায়েল তার লক্ষ্য অর্জনে
সফল হয়েছে। তবে, তার সেই কথিত সাফল্যের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের
ভূমিকাই প্রধান। জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্র্র দূতাবাসের রেশ তাই সহসাই কাটবে এমনটি ভাবার
কোনো কারণ নেই। বেআইনী ও অন্যায় দখলদারির অবসান না হওয়া পর্যন্ত এই মৃত্যুর মিছিলের
শেষ নেই।
(১৮ মে, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের কলাম।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন