সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

গোষ্ঠীগত উগ্রতা যেসব কারণে নিন্দনীয়


সরকারী পদক্ষেপের কারণে বন্ধ থাকা আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান একটি মানহানির মামলায় কুষ্টিয়ার আদালতে হাজিরা দিতে গেলে আদালত প্রাঙ্গণে তার ওপর ছাত্রলীগ কর্মীরা যে হামলা চালিয়েছে তাকে কেন্দ্র করে দেশে, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটা বিতর্ক চলছে। এই বিতর্কেও যথারীতি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের বিভাজন স্পষ্ট। কিন্তু, এই দলীয় দৃষ্টিকোণের বাইরেও যে একটা যৌক্তিক ভিন্নমত আছে তা এড়িয়ে যাওয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের জন্য মোটেও সুখকর নয়।
এক্ষেত্রে প্রথমেই দেখা প্রয়োজন যে আদালতে বিচারাধীন মামলা অন্য কারো বিচার করার অধিকার আছে কীনা ? যদি না থাকে তাহলে আদালত যাঁকে জামিন দিয়েছে তাঁকে এজলাসের বাইরে যাঁরা শায়েস্তা করার চেষ্টা করেছেন তাঁদের নিন্দা করা জরুরি। তা নাহলে আইনের শাসনের বদলে আমাদেরকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর দলবদ্ধ উন্মত্ততার শাসন (Mobocracy) প্রতিষ্ঠা পাবে।
দ্বিতীয়ত: সম্পাদক কিম্বা সাংবাদিক অথবা অন্য যে কোনো পেশার মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে তার ওপর হামলা কখনেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়খুব পুরোনো একটা প্রবচন। এক্ষেত্রে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ে সাংবাদিকনেতা, বর্তমানে বাংলাদেশ অবজারভারের সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর ওপর ২০০৬ সালে কুষ্টিয়ায় হামলার কথা উল্লেখ করে কেউ কেউ আমাদেরকে সেকথাই স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন। এই পাল্টাপাল্টি প্রতিশোধ গণতন্ত্রে অচল এবং উভয় হামলারই নিন্দা ও হামলাকারীদের বিচার করা উচিত।
তৃতীয়ত: একাধিক নিন্দনীয় অপরাধের জন্য মাহমুদুর রহমানের প্রতি ক্ষেভের বহিপ্রকাশ হিসাবে যাঁরা যুক্তি দেখাচ্ছেন তা  অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি প্রবণতা। তাঁদের অভিযোগ তিনি নিজের পত্রিকায় অসত্য তথ্য প্রকাশ করেছেন এবং যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ আন্দোলনের সময়ে ব্লগারদের পরিচয় প্রকাশ করে তাঁদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলেছিলেন। একইধরণের অসত্য তথ্য প্রকাশ ও প্রচারের অভিযোগ অন্য দুএকটি কাগজের বিরুদ্ধেও আছে। কিন্তু, সরকারের কৃপাদৃষ্টিতে থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপও নেওয়া হয় নি। অভিযোগগুলো গুরুতর এবং সেগুলোর বিচারের আইনী পন্থা আছে এবং সেই পথেই এসব অভিযোগের নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। এর অন্যথা হলে একইধরণের অভিযোগে আর কোনো সাংবাদিককে যে হেনস্থার মুখে পড়তে হবে না তার নিশ্চয়তা কি? বর্তমানে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ভুলভাবে ছাত্র শিবিরের কর্মী হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের পরিবারের খুঁটিনাটি প্রকাশ করে তাঁদের জীবনকে যে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা হয়েছিল সেই অভিজ্ঞতার কথা এখানে স্মরণ করা যায়। যাঁরা মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে জনরোষ বা গণধোলাইয়ের শিকার বলে হামলার যৌক্তিকতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন কোটা আন্দোলনের নেতাদের বেলাতেও তাঁরা এ্কই কথা বলে থাকেন সাধারণ শিক্ষার্থীর খোলসে। এটি সমর্থনযোগ্য নয়।
চর্তূথত: পেশাগত যোগ্যতার প্রশ্ন তুলে এধরণের হামলাকে উপেক্ষা করা মোটেও সঙ্গত নয়। মাহমুদুর রহমানের ক্ষেত্রে এডিটর বাই চান্সঅভিধাটি আদালত প্রয়োগ করলেও বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে খুব কমই পেশাদার সাংবাদিক সম্পাদকের আসনটিতে স্থান পেয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনিয়োগ যাঁর তিনিই সম্পাদক বা প্রধান সম্পাদক। এঁদের অনেকে উত্তরাধিকার সূত্রেও ওই পদে আসীন হয়েছেন। তাহলে কি যাঁরা সাংবাদিকতা পেশার বাইরে যিনি বা যাঁরা সম্পাদক হয়েছেন তাঁদের ওপর হামলার বিষয়টি সহনীয় বলে গণ্য হবে?
প্ঞ্চমত: রাজনৈতিক বিশ্বাস বা পক্ষপাতের কারণে কোনো সংবাদপত্র, সম্পাদক ও সাংবাদিকের ওপর হামলা সমর্থনযোগ্য নয়। সব দেশেই সংবাদপত্রের কাছে নিরপেক্ষতা প্রত্যাশিত হলেও অনেকেরই রাজনৈতিক পক্ষপাত থাকে। আবার, সরাসরি রাজনৈতিক দলের প্রকাশনা হিসাবেও পত্রিকা প্রকাশিত হয়ে থাকে। একসময় বাংলার বাণী আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসাবে পরিচিত ছিল। এখন সরকার সমর্থক কাগজের আধিক্যের কারণে দলীয় কাগজের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। বিএনপির দলীয় প্রকাশনা হচ্ছে দিনকাল। কিন্তু, দলীয় প্রকাশনা বলেই তার মতপ্রকাশের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের চেষ্টা বা হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে, দলীয় অবস্থান থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচ্য নয়। গণতন্ত্রে ভিন্নমতের সুরক্ষায় দলমতনির্বিশেষে সবারই ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
ষষ্ঠত: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কথিত মানহানির মামলা হয়রানির একটা বিপজ্জনক হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ফৌজদারি আইনের বাইরেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাও এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। সম্প্রতি জনকন্ঠের সাংবাদিক জাফর ওয়াজেদ এর বিরুদ্ধেও ৫৭ ধারায় মানহানির মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। রাজনৈতিক বিভাজনের বাস্তবতায় ভিন্নমতের সাংবাদিক হেনস্থার শিকার হলে বিষয়টি সহনীয় বলে উপেক্ষিত হলে তা সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়। সুতরাং, রাজনৈতিক বৃত্তের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার সুরক্ষায় দলমতনির্বেশেষেই এধরণের উন্মতত্তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
এখানে আরও বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে পুলিশ হামলাকারীদের নিবৃত্ত করতে প্রয়োজনের সময়ে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয় নি। ফলে, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের অন্যায় আচরণের প্রতি একধরণের সহনীয়তা বা প্রশ্রয় লক্ষ্য করা গেছে। ছাত্রলীগ বা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের প্রতি এই বিশেষ পক্ষপাত আসলে সারা দেশেই একটি নিয়মে পরিণত হতে চলেছে তা সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর হামলাই হোক অথবা শিক্ষক নিগ্রহের ঘটনাই হোক।
(২৪ জুলাই, ২০১৮ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...