সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

যে প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন, কিন্তু তীক্ষ্ণ

প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন, কিন্তু তীক্ষ্ণ। ফলে, যাঁকে উদ্দেশ্য করে এই আয়োজন তাঁর ওপর প্রতিবাদ শুরুর আগেই তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এই প্রতিবাদের কেন্দ্র হচ্ছে লন্ডন এবং এর লক্ষ্য হলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। লন্ডনের আকাশে প্রবেশ করার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর এয়ারর্ফোস ওয়ান বিমানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই হয়তো তাঁর চোখে পড়বে ক্ষুব্ধ লন্ডনবাসীরা তাঁকে কিধরণের উপহাসের পাত্র বিবেচনা করেন।

প্রতিবাদের আয়োজকদের ভাষায় ব্যাক্তি ডোনাল্ড জে ট্রাম্প একজন বর্ণবাদী, মুসলিম ও নারী বিদ্বেষী, বিভেদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, এবং ভীষণরকম অহংকারী। অন্যদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য এবং অপমান করায় বিকৃত আনন্দ উপভোগ করেন। টুইটারে তাঁর টুইটগুলো এসবেরই স্বাক্ষ্য বহন করে। সুতরাং, বিক্ষোভের আয়োজনকারীরা তাঁকে একইধরণের ভাষায় স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। লন্ডনের প্রতিবাদে লক্ষাধিক মানুষ অংশ নেবেন বলে অধিকাংশের ধারণা। তবে, প্রতিবাদের মূল আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকছে শিশু ট্রাম্পের চেহারায় তৈরি এক বিশালাকায় বেলুন। এই বেলুন উড়বে লন্ডনের আকাশে যাতে তা শহরের নানা প্রান্ত থেকে দেখা যায়।

শুধু ন্যাপি পরা শিশু ট্রাম্পের বেলুনটি প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে এতোটাই মোক্ষম হয়ে উঠেছে যে এখন স্কটল্যান্ডেও এটি ওড়ানোর অনুমতি চেয়ে অনলাইন আবেদনে গণস্বাক্ষর দেওয়া শুরু হয়েছে। স্কটল্যান্ডের টার্নবেরিতে ট্রাম্পের যে গলফ কোর্স আছে এবং যেখানে তিনি আগামী শনি-রবিবার অবকাশ কাটাবেন বলে কথা রয়েছে, সেখানেও এই বেবি ট্রাম্প বেলুন ওড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের, যাকে উভয় দেশের নেতারা বিশেষ সম্পর্ক বলে অভিহিত করে থাকেন। বিশেষ বন্ধুত্বের পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জন্য এই বিচিত্র আয়োজন এবং প্রতিবাদ এক নতুন নজির স্থাপন করতে চলেছে। তবে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই ব্যাঙ্গাত্মক বেলুন ওড়ানোর বিরোধীতাও আছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসূত্রে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়া সাংবাদিক পির্য়াস মর্গান এবং তাঁর রাজনীতির সমর্থক বিটেনের অভিবাসনবিরোধী রাজনীতিক নাইজেল ফারাজ এই বেলুনকে অতিথিকে অপমান করার সমতুল্য বলে অভিহিত করেছেন।

লন্ডনে জঙ্গি হামলা এবং অপরাধের জন্য বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেনের অভিবাসন নীতি ও মেয়র সাদেক খানের অযাচিত ও অসত্য সমালোচনা করায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রতি অসন্তোষ তৈরি হয়। এমনকি, উগ্র ডানপন্থী একটি নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর মুসলিমবিদ্বেষী ভিডিও টুইটারে পুনপ্রচারের জন্য একসময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট বিষয়েও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান সুবিদিত। তিনি ব্রেক্সিটের সমর্থক এবং সদ্য পদত্যাগ করা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের অনুরাগী। লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে ব্রাসেলসের সংবাদ সম্মেলনেও তিনি ব্রিটেনের অভিবাসননীতির বিষয়ে বলেছেন যে এই সমস্যায় তাদেরকে নজর দিতে হবে। অভিবাসন প্রশ্নে ব্রিটেনের সবাই তাঁর সঙ্গে একমত পোষণ করেন  বলেও তিনি দাবি করেন।

প্রতিবাদ-বিক্ষোভের কারণে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তনের আশা কেউই করেন না। কিন্তু, লন্ডন-বিক্ষোভের আয়োজকরা প্রতিবাদ শুরুর আগেই যে সাফল্যটুকু অর্জন করেছেন তাও কম কিছু নয। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরসূচি এখন এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে তিনি কার্য্যত লন্ডনকে এড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি শুধু প্রথম রাতটা কাটাবেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাসায়। বাকি সবকিছুই হচ্ছে লন্ডনের বাইরে। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি হবে লন্ডনের বাইরে বাকিংহামশায়ারে প্রধানমন্ত্রীর সরকারী কান্ট্রি হাউজ চেকারসে। আনুষ্ঠানিক ভোজসভাও হবে অক্সফোর্ডশায়ারের ব্লেনহেইম প্যালেসে। আর, রাণীর সঙ্গে সাক্ষাত হবে বাকিংহাম প্রাসাদের বদলে উইন্ডসর ক্যাসেলে।

আর, লন্ডনে তাঁর প্রথম রাতটির জন্য রাষ্ট্রদূতের বাসা ঘিরে যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা নজিরবিহীন। আলাদা করে সাময়িক সময়ের জন্য সেখানে কাঁটাতারের বেষ্টনি স্থাপন করা হয়েছে। আর, যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস লন্ডনে বসবাসরত আমেরিকান নাগরিকদেরকে বাড়তি সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলেছে বিক্ষোভ সহিংস হয়ে উঠলে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মায়ের জন্ম স্কটল্যান্ডের হেব্রিডিয়ান আইল্যান্ড অব লুইসে। স্কটল্যান্ডের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূলে টার্নবেরিতে রয়েছে তাঁর গলফ ক্লাব এবং অবকাশ কেন্দ্র। তবে, স্কটিশ সরকারের কেউ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে স্বাগত জানাচ্ছেন না। এমনকি, রাজ্য সরকারের কেউ তাঁর সাথে সৌজন্য সাক্ষাতও করছেন না।

প্রধানমন্ত্রী মের সরকার ব্রেক্সিট-উত্তর ব্রিটেনের বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতির ভবিষ্যত বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সফরকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। এই সফরে তার কতটা অর্জিত হবে বলা মুশকিল। বিশেষ করে পাশ্চাত্যের সামরিক জোট নেটোর শীর্ষসম্মেলনে তিনি যেসব নাটকীয়তার জন্ম দিয়েছেন তাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একধরণের অস্বস্তি বজায় থাকাই স্বাভাবিক। তবে, এসব কিছু ছাপিয়ে লন্ডনের প্রতিবাদ একটা ব্যাতিক্রমী স্মারক হয়ে থাকবে সন্দেহ নেই। 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...