সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বাংলা বিভ্রাট চাই না


বাংলা এখন কি? একটি স্বাধীন দেশ? ভারতের একটি রাজ্য? নাকি ভাষা?

গত ৪৭ বছর ধরে একটি স্বাধীন দেশের সাত থেকে ষোলো কোটি মানুষ যখনই জাতীয় সঙ্গীতে পরম মমতায় আমার সোনার বাংলাউচ্চারণ করে এসেছে তখন কিন্তু সবাই বাংলাদেশকেই বুঝেছে। সেটা শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতসহ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে, যেকোনো উপলক্ষ্যে এই জাতীয় সঙ্গীতের সুরের অনুরণনে বাংলাদেশকেই বোঝানো হয়েছে এবং সবাই সেটি ছাড়া অন্য কিছু কল্পনাও করেন নি।

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের রাজ্য বিধানসভায় গেল সপ্তাহে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে যে তাঁরা তাঁদের রাজ্যকে বাংলা নামে নামকরণ করতে চান। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবটিতে সম্মতি দিলে তা লোকসভা এবং রাজ্যসভায় উত্থাপিত হবে এবং সেখানে অনুমোদিত হলে সরকারীভাবে ভারতীয় রাজ্যটির নাম বদলে বাংলা হবে।

একথা ঠিক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের শ্লোগান জয় বাংলা ছাড়া বাংলার মানে হচ্ছে ভাষা। জয় বাংলা শ্লোগানের বাংলা কিন্তু বাংলাদেশ এবং ভারতেও তা স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর তো বটেই এখনও পশ্চিম বঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ গেলে তাঁদেরকে অনেকেই জয় বাংলার লোক বলে চেনে বা ওই পরিচয়টাকেই বড় করে দেখে।

ভাষা হিসাবেও বাংলার যে প্রসার তাতে পশ্চিম বঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিক ও গণমানুষের ভূমিকা থাকলেও প্রাধান্যটা কিন্তু বাংলাদেশের। জাতিসংঘে বাংলায় বক্তৃতা থেকে শুরু করে ভাষা শহীদ দিবসের আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি আদায়ের মাধ্যমে তাকে বিশেষ মর্য্যাদার আসনে আসীন করার মূল কৃতিত্ব বাংলাদেশের। বর্তমান যুগে যেকানো কিছুরই মূল্য তৈরি হয় বা বাড়ে তখনই যখন তার পরিচিতির প্রসার ঘটে। বাণিজ্যিক জগতে একে বলা হয় ব্র্যান্ড ভ্যালু। বাংলারও সেই ব্র্যান্ড ভ্যালুতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা বাংলাদেশের।

কিন্তু, এসব কিছুতেই এখন তালগোল পাকানোর পরিস্থিতি, অর্থা্ৎ বাংলা বিভ্রাট তৈরি হবে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতে যেমন বাংলাকে বাংলাদেশ করা সম্ভব নয়, তেমনই পঁচিশ কোটি বাংলাভাষীর ষোলো কোটি জয় বাংলা শ্লোগানে পশ্চিমবঙ্গের কথা বলবে না (২০১৬র পরিসংখ্যান অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা নয় কোটি)।

বাংলাদেশ এবং ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ উভয় ভূখন্ডেই বাংলা কথাটির সঙ্গে আবেগ জড়িয়ে আছে। ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রশ্নও এক্ষেত্রে কম গুরুত্বর্পূণ নয়। কিন্তু, সেসব বিষয়ে ঊভয় ভূখন্ডের অগ্রসর জনগোষ্ঠী তথা শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবি এবং রাজনীতিকদের মধ্যে কোনোধরণের মতবিনিময় বা আলোচনার কথা জানা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রগুলোর মাধ্যমে যা জানা যায় তাহোল তাঁদের এই নামবদলের উদ্যোগ মূলত রাজনৈতিক। মূখ্যমন্ত্রীদের সম্মেলনে সর্বভারতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজিতে রাজ্যের নামের আদ্যক্ষর অনুযায়ী মূখ্যমন্ত্রীরা কথা বলার সুযোগ পান। ফলে, সবসময়ে দেখা যায় ওয়েস্ট বেঙ্গল এর মূখ্যমন্ত্রী পিছনে পড়ে যাচ্ছেন যখন সম্মেলনে অনেকেরই আর মেনোযোগ থাকে না। বাংলা নামকরণ হলে আদ্যক্ষর বির সুবাদে শুরুর দিকেই রাজ্যটির মূখ্যমন্ত্রীর কথা বলার সুযোগ হবে। এই রাজনৈতিক সুবিধাটুকু রাজ্যটির জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ওই রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের কি অন্য আর বিকল্প নেই ? সেখানেও কেউ কেউ বলেছেন যে ইংরেজি আদ্যক্ষরের সমাধান বঙ্গ নামকরণেও সম্ভব। তাছাড়া, ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার প্রস্তাবে বাংলার ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষান্তর বেঙ্গল এবং বাঙাল প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু, এখন তিন ভাষাতেই বাংলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বঙ্গের ইংরেজিও বেঙ্গল হওয়ায় বাংলা নামগ্রহণের মাধ্যমে নতুন সংশয়ের জন্ম না দিয়েও রাজনৈতিক সমস্যার বিকল্প সমাধান সম্ভব ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষীর আবেগ এবং অর্জনগুলো  উপেক্ষা করার কারণে যে সমস্যা তৈরি হবে তা বরং বাংলাভাষীদের মধ্যে সংশয় ও বিভাজন তৈরি করবে।

বাংলা ভাষা এবং বাংলাদেশ এই দুটোর জন্যই কিন্তু রক্ত দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী। এবিষয়ে বাংলাদেশের সরকার এবং শিল্পী-সাহিত্যিকদের নীরবতা বিস্ময়কর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারসহ রাজনীতিক ও নাগরিকসমাজের কাছে এই পরিবর্তনের সমস্যাগুলোর কথা আমাদের দ্রুতই তুলে ধরা দরকার। তাঁদেরকে ওই পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা যত দ্রুত করা যায় ততোই ভালো।

নাম নিয়ে তোলগোল পাকানোর ঘটনা বিশ্বে একেবারে বিরল নয়। এখানে একেবারে তরতাজা উদাহরণই দেওয়া যায়। মাত্র গত মাসেই ইউরোপের দুটি দেশ মেসিডোনিয়া এবং গ্রীস তাদের মধ্যে কয়েক দশক ধরে চলা নাম বিতর্কের একটা সমাধানে সম্মত হয়েছে। গ্রীসের উত্তরাঞ্চলের মেসিডোনিয়া এবং ১৯৯১ সালে সাবেক যুগোশ্লাভিয়া ভেঙ্গে তৈরি হওয়া নতুন রাষ্ট্র মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্র এই দুইয়ের মধ্যে মেসিডোনিয়া নিয়ে যে বিভ্রান্তি তৈরি হয় তা সমাধানে গত ১৭ জুন দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় পৌঁছেছে। গ্রীসের মেসিডোনিয়ার ইতিহাস অতিপ্রাচীন। সেই ঐতিহ্যই শেষপর্যন্ত প্রাধান্য পেয়েছে এবং মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্রের নতুন নাম হচ্ছে উত্তর মেসিডোনিয়া প্রজাতন্ত্র। অন্যরা যখন দেশের নাম নিয়ে সংশয় দূর করে, তখন আমাদের কি যেচে পড়ে সমস্যা তৈরি করা উচিত?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime in N

একটি জরিপ, নৈরাশ্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন

উন্নত গণতন্ত্রে সরকার , সরকারপ্রধান, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল এবং বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুতে প্রায়ই জনমত জরিপ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো সংবাদমাধ্যম, আবার কখনো বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব জরিপ করায়। বেশ কিছু পেশাদার জরিপকারী প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা শুধু জরিপের কাজ করে। এসব জরিপ আমাদের গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন ভোটের মতো নয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু সেই ওয়েবসাইটের নিয়মিত ব্যবহারকারীদের মতামত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রায় দুই দশক বার্ষিক জরিপে রাজনীতির গতিপ্রকৃতির চমৎকার প্রতিফলন দেখা যেত। কিন্তু গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে জরিপ করতে গেলে সরকারের সায় আছে কিনা সেটা দেখা হয়, নইলে পেশাদার বিশেষজ্ঞরা বা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো ওই দায়িত্ব নিতে চান না। কথা বলার ভয়ের মতো মতামত জানতে চাওয়াতেও এক ধরনের ভয়ের আসর পড়েছে। গণতন্ত্র প্রসারে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট, আইআরআই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা এখনো মাঝে মধ্যে স্পর্শকাতর রাজন

ভিসা নিষেধাজ্ঞা গুরুতর, সাংবাদিক নির্যাতন কী

একই দিনের দুটি সংবাদ শিরোনাম, ’৯ মাসে ২১৭ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার: আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এবং ’পিটার হাসের বক্তব্য স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর চাপ, সমাবেশে সাংবাদিকনেতারা’। দুটো খবরই সাংবাদিকতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে। তবে একটি খবর, যাতে আছে সেই সব সাংবাদিকদের কথা, যাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শারীরিক ক্ষতি অথবা গ্রেপ্তার ও মামলার কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন; আর অন্যটিতে ভবিষ্যতে কোনো গণমাধ্যমকর্মী যুক্তরাষ্ট্র যেতে চাইলে ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি বা তাঁর যে সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কা। সাংবাদিকদের নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়ে গবেষণার কাজ ও তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছে একটি মানবাধিকার সংগঠন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার দুশ্চিন্তায় প্রতিবাদী হয়েছেন সাংবাদিকদের অপেক্ষাকৃত নতুন একটি প্লাটফর্ম জাস্টিস ফর জার্নালিস্ট।  বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিয়মিত কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির মত অধিকার লংঘনের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তারই অংশ হিসাবে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতার ওপর তাদের আলাদা মনোযোগ। তাদের প্রকাশিত হিসাব