সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ছাত্রলীগের দায় অস্বীকার ও কোটা সংস্কারে অনীহা


কোটা সংস্কারের আন্দোলন নতুন করে চাঙ্গা হওয়ার পর সংগঠকদের পিটিয়ে শায়েস্তা করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে সেই গুন্ডামির দায় অস্বীকার করেছে ছাত্রলীগ। হামলায় জড়িতদের সাংগঠনিক পরিচয় প্রকাশের পরও সংগঠনের নেতারা দাবি করেছেন সাধারণ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ রক্ষার প্রয়োজনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টাকে প্রতিহত করেছে। প্রথমে অবশ্য এটিকে আন্দোলনকারীদের নিজেদের গন্ডগোল হিসাবে অপব্যাখ্যার চেষ্টাও হয়েছিল। ছাত্রলীগের এই ভূমিকার ব্যাখ্যা কি? অপকর্মের জন্য লজ্জা পেয়ে অনুশোচনা ? নাকি, এটি প্রমাণের চেষ্টা যে এসব হামলা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা, যার সঙ্গে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কোনো সম্পর্ক নেই ?

গত কয়েকদিনে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় : ১. এই সময়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তির্পূণ সংবাদ সম্মেলন এবং মানববন্ধনের মত কর্মসূচিতে হামলা চালিয়ে সেগুলো ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে;  ২. টেলিভিশনের পর্দা বা খবরের কাগজে আসা ছবিতে দেখা গেছে ছাত্রীরা লাঞ্ছিত হয়েছেন (যার মধ্যে যৌন নিপীড়ণও রয়েছে) ; ৩. আন্দোলনের একাধিক নেতাকে অপহরণ করে নিপীড়ণ এবং পরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে ; ৪. ফেসবুকে সরসারি বক্তব্য সম্প্রচারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা দায়ের; এবং ৫.ক্যাম্পাসে সন্দেহের বশে সাধারণ নাগরিকদের লাঞ্ছিত করা। দেশের প্রচলিত আইনে এগুলোর প্রত্যেকটিই শাস্তিযোগ্য অপরাধ।  

এসব ঘটনায় ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রশাসনের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং পুলিশের একধরণের তাল মিলিয়ে চলার আলামতও স্পষ্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে ছাত্রলীগের হামলার সময়ে মাত্র কয়েকশো গজ দূরে শাহবাগে অবস্থানরত পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তাঁদের ব্যাখ্যা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া তাঁরা সেখানে কিছু করতে পারেন না। আবার, দ্বিতীয় দিনে কেন্দ্রীয় শহীদমিনারে মানববন্ধনের কর্মসূচির আগে সেখানে পুলিশ থাকলেও ছাত্রলীগ হামলা চালানোর আগে তারা সেখান থেকে সরে যায়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারের সামনে হামলা থেকে ছাত্রদের রক্ষা করতে দুএকজন শিক্ষক সচেষ্ট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর দুদিনের ঘটনার কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন। কেননা, তাঁর কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করে নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃংখলার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার কলাভবনের দপ্তরে যে গোলযোগের আওয়াজ এমনিতেই পৌঁছানোর কথা, অভিযোগ না পেলে তিনি সেই হাঙ্গামা টের পান না।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ এবং পেটোয়া (ছাত্র)লীগ এর মধ্যে এই অদ্ভূত সমন্বয় কাকতালীয় বলে কেউ হয়তো দাবি করতে পারেন। কিন্তু, সন্দেহটা আরও জোরালো হয় যখন আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল নাগরিকদের আইনগত প্রতিবাদ সমাবেশে পুলিশ মারমুখী হয়ে ওঠে। এতোকিছুর পরও যখন আন্দোলনকারীদের দমানো যাচ্ছে না, মিছিল-প্রতিবাদ চলছেই, তখন ক্ষমতাসীন দল এবং সরকার এতে উসকানি এবং রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র আবিষ্কারের কৌশল বেছে নিয়েছেন। সরকারের যেকোনো সমালোচনা এবং ভিন্নমতকে জামাত-শিবিরের ষড়যন্ত্র অভিহিত করার বিষয়টি ক্ষমতাসীনদের অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্ন তাই খুবই স্বাভাবিক। ভুল নীতি কিম্বা পদক্ষেপের যৌক্তিক বিরোধীতায় আন্দোলনকারীরা বিরোধীদল বিএনপি কিম্বা তাদের বর্তমান মিত্র জামাতের সমর্থন কখনও চেয়েছেন এমন কোনো তথ্য কোথাও পাওয়া যায় না। আবার, রাজনীতিতে এসব দল  নিষিদ্ধও নয়। সুতরাং, কোটা সংস্কারের আন্দোলনকে এসব দল সমর্থন করলেই তাকে ষড়যন্ত্র অভিহিত করা বিশ্বাসযোগ্য হয় কিভাবে?

কোটা সংস্কার বিষয়ক ঘটনাক্রম পর্যালোচনায় ধারণা হয় সরকার এই সংস্কারের যৌক্তিকতা মানতে প্রস্তুত নয়। এই আন্দোলন ভাঙ্গার চেষ্টায় এর আগেও ছাত্রলীগ ক্যাম্পসে শাক্তির মহড়া দিয়েছে, সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের মারধোর করেছে। রোকেয়া হলে মধ্যরাতের হাঙ্গামার কথা সহজে কারো ভোলার কথা নয়। তবে, গত এপ্রিলের প্রথম দিকে আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দেন যে কোটা থাকবে না। সংস্কারের বদলে পুরো ব্যবস্থাটি বাতিলের ঘোষণায় স্পষ্টতই সবাই বিস্মিত হন। বিস্ময় আরও বাড়ে যখন আন্দোলনকারীদের হেনস্থা করার জন্য সমালোচিত ছাত্রলীগ তখন ওই ঘোষণার পর আন্দোলনের কৃতিত্ব দাবি করে বিজয় মিছিল করে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উপায় ঠিক করার জন্য তখন সরকারীভাবে জানানো হয় যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হবে। এরপর আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্তরা আলোচনায়ও বসেন। কোটাসংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খান সোমবার আদালতে বলেছেন তিনদফা এই বৈঠক হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর রিমান্ড আবেদনের শুনানির সময়ে তিনি আদালতকে জানিয়েছেন যে সর্বশেষ বৈঠকটি হয়েছে গত ১৪ মে।

অথচ, ওই একই দিনে সরকারের জ্যৈষ্ঠতম আমলা মন্ত্রীপরিষদ সচিব কোটার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার অগ্রগতি সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, এটা সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে। আমাদের পর্যায়ে এখনো আসেনি। ওই একই দিন সন্ধ্যায় সরকারের আরেকটি ঘোষণায় একটি কমিটি গঠনের কথা জানানো হয় যে কমিটিকে পনেরো দিনের মধ্যে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। এই কমিটিতে কোনো শিক্ষাবিদ কিম্বা বিশেষজ্ঞকে রাখা হয় নি। শুধুমাত্র সরকারী আমলাদের নিয়ে গঠিত এই কমিটি সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে কোনো মতামত দিতে সক্ষম হবে এমনটি ভাবা কঠিন।

কোটা সংস্কারের দাবিকে শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে দমিয়ে রাখায় ছাত্রলীগের গুন্ডামি, চাপের মুখে কমিটি গঠনের ঘোষণা এবং আন্দোলনে ষড়যন্ত্রের তকমা লাগানোর চেষ্টায় কোনো শুভ ইঙ্গিত মেলে না।

সরকার তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে না দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সফল হওয়ায় তার মধ্যে সম্ভবত একটা অন্যধরণের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। যে দলের উত্থান এবং বিকাশ আন্দোলনে সেই আওয়ামী লীগের নেতারা এখন হয়তো আরও আত্মবিশ্বাসী যে তাদেরকে রাজনৈতিক চাপ দিয়ে কেউ কিছু আদায় করতে পারবে না। কিন্তু, তাঁরা বুঝতে পারছেন না যে এই আত্মবিশ্বাস তাঁদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে তুলছে, প্রশাসন এবং পেশিশক্তির ওপর নির্ভরশীল করে ফেলছে। এধরণের শাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রসম্মত নয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...