নির্বাচনের পরাজয় মানতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অস্বীকৃতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক টানাপোড়েনের দিকে যখন সবার নজর, ঠিক তখনই ১১০টি দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতিসংঘ ফোরামে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় অনেক অস্বস্তিকর পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। অবশ্য, সেদিকে সংবাদমাধ্যমের খুব একটা দৃষ্টি পড়েনি। ৯ নভেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে দেশটির এই সর্বজনীন পর্যালোচনা বা ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) অনুষ্ঠিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে বর্ণের ভিত্তিতে কাঠামোগত বৈষম্যের বিষয়টি। বর্ণ, ধর্ম এবং নারী-পুরুষভেদে বৈষম্য, বিদ্বেষসৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রচার, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা এবং অভিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের অবসান ঘটানোর পাশাপাশি বিচারব্যবস্থার সংস্কারের জন্য এই পর্যালোচনায় দেশটির প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার, বিক্ষোভ দমনে পুলিশের শক্তিপ্রয়োগ এবং সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি তৈরির বিষয়গুলোও বাদ যায়নি। এই ফোরামে জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা কথিত সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক লড়াইয়ের সময়ে মানবাধিকার ও মানবিক আইনগুলো লংঘনের প্রশ্নে দায়মুক্তির অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
মানবাধিকারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বহুল আলোচিত এবং বিতর্কিত। বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর প্রতিবছর একটি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মানবাধিকারের অন্যতম অংশ ভোটাধিকার এবং স্বচ্ছ্ব ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথাও তাতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের নিজের নির্বাচন এবারে যেভাবে বিতর্কিত হচ্ছে, তাতে অন্য দেশের সমালোচনা ভবিষ্যতে কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বস্তুত, মানবাধিকারের অনেকগুলো বিষয়ে ওবামা প্রশাসনের নেওয়া কিছু সংস্কার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উল্টেও দিয়েছেন। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওবামা তাঁর অভিষেকের সময়ে বিশ্বের নানাপ্রান্তে সিআইএর অঘোষিত গোপন বন্দীশালাগুলো বন্ধ করা ও হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে ওয়াটারবোর্ডিংয়ের মত নিষ্ঠুর নির্যাতন নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি গুয়ানতানামোর বন্দীশিবির তাঁর মেয়াদকালেই বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাঁর আটবছরের শাসনকালে গুয়ানতানামো বন্ধ হয়নি, কিন্তু গোপন বন্দীশালা ও নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধ হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওয়াটারবোর্ডিং আবারও ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন, তবে কতোটা পেরেছেন তা স্পষ্ট নয়। বৈষম্যমূলক নানা পদক্ষেপ নিয়ে ও বিদ্বেষ ও ঘৃণার প্রসারে উৎসাহ দিয়ে তিনি নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে আছে কয়েকটি মুসলিম দেশের ভ্রমণকারীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, অভিবাসনকামীদের প্রতি কড়াকড়ি, অভিবাসীদের সন্তানদের বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করা, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীদের দমনে বাড়াবাড়ি রকমের শক্তি প্রয়োগ ইত্যাদি।
নির্বাচনের আগে এবং পরে বিজয়ী জো বাইডেনএসব বিষয়ে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি দায়িত্বগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম ভ্রমণকারীদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া ও অভিবাসী সন্তানদের বাবা-মায়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর নির্বাচনী ঘোষণায় আলাদা করে ইসলামভীতি বা ইসলামোফোবিয়া মোকাবিলার কথা আছে। মুসলিম-আমেরিকান সম্প্রদায়ের জন্য জো বাইডেনের এজেন্ডা শীর্ষক রচনায় তিনি মুসলিম আমেরিকানদের সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকারগুলো সুরক্ষার কথা বলেছেন। বলেছেন, তিনি এমন আইন করতে আহ্বান জানাবেন যাতে ভবিষ্যতে কোনো প্রশাসন এধরণের নিষেধাজ্ঞা দিতে না পারে। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের সব সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানবাধিকারকে আবারও স্থান দেওয়া হবে ঘোষণা করে এই কর্মসূচিতে তিনি তাঁর মেয়াদের প্রথম বছরেই গণতন্ত্রবিষয়ক এক শীর্ষসম্মেলন আয়োজনের কথা বলেছেন।
মুসলিমপ্রধান এবং মুসলমান সংখ্যালঘু দেশগুলোতে যা ঘটছে, তাতে মুসলিম-আমেরিকানদের অনুভূতি বাইডেন অনুভব করেন জানিয়ে এতে বলা হয়েছে যে, চীনের শিনজিয়াংয়ে বন্দীশিবিরগুলোতে যাঁরা আটক আছেন তাঁদের বিষয়ে তিনি কথা বলবে। যেসব কোম্পানি এসব উইঘুর মুসলমানদের নিপীড়ণের সহযোগী তাদের বিরুদ্ধেও তিনি ব্যবস্থা নেবেন। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ণ এবং প্দ্ধতিগত বৈষম্যকে জঘণ্য অভিহিত করে তিনি বলেছেন এগুলো শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে।
ভারত সরকারের কাশ্মীরে সব মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া
উচিত উল্লেখ করে বাইডেন বলেছেন শান্তির্পূণ প্রতিবাদ করতে না দেওয়া, ভিন্নমত প্রকাশে
বাধা দেওয়া এবং ইন্টারনেট বন্ধ রাখা বা তার গতি কমিয়ে দেওয়া গণতন্ত্রকে দূর্বল করে।
আসামে নাগরিকদের জন্য জাতীয় রেজিষ্ট্রার বাস্তবায়নে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ এবং নাগরিকত্ব
আইন সংশোধনে বাইডেন হতাশ হয়েছেন জানিয়ে এতে বলা হয় বহু-জাতিগোষ্ঠী এবং বহুধর্মীয় গণতন্ত্র
টিকিয়ে রাখা এবং দেশটির ধর্মনিরপেক্ষতার র্দীঘ ঐতিহ্যের সঙ্গে এসব পদক্ষেপ সঙ্গতির্পূণ
নয়।
মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য রাজনৈতিক
এবং অর্থনৈতিক সংস্কার অনেকদিনের চাহিদা বলেও এতে বলা হয়েছে। দেশে-বিদেশে সৌদি আরবের
মানবাধিকার লংঘনকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘নির্শতে মেনে নেওয়ার‘ সমালোচনা করে বাইডেন মিত্র এবং প্রতিদ্বন্দী সবার সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়ে
কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। ইয়েমেনে যুদ্ধ বন্ধের কথাও আছে তাঁর এই ঘোষণায়। ইজরায়েল এবং
ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে আবারও দুইরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বিষয়ে সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী হবেন জানিয়ে বাইডেন ইজরায়েলের বসতি সম্প্রসারণ এবং
পশ্চিম তীরে দখলে নেওয়ার বিরোধীতার কথা বলেছেন। তিনি র্পূব জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের
কনসুলেট সেবা আবারও শুরু করা এবং আবারও ফিলিস্তিনীদের সাহায্য চালু করার অঙ্গীকার করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতিতে যেসব পরিবর্তনের কথা
তিনি মুসলিম-আমেরিকানদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেছেন, তাতে দুটো বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে।
প্রথমত: প্রায় এক কোটি দশ লাখ অভিবাসী যাদের কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই, তাঁদের বৈধতা দেওয়া
এবং দ্বিতীয়ত: দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বছরেই বৈধভাবে সোয়ালাখ অভিবাসনকামীকে অভিবাসনের
সুযোগ দেওয়া। এসব পরিবর্তনের কতটা তিনি কার্যকর করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই
পারে। বিশেষত: ওবামা প্রশাসনের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যাক্তি হিসাবে তিনি এগুলোর জন্য
কতটা ভূমিকা রেখেছেন, সেই রেকর্ডও পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। তবে, এবারে তিনিই মূল ভুমিকায়।
সুতরাং, অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হলে তার দায় তাঁকেই নিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, মানবাধিকার
এবং বিদ্বেষ ও বৈষম্যের রাজনীতির বিবেচনায় ট্রাম্পের বিপরীতে বাইডেন কিছুটা যে আশার
সঞ্চার করছেন, তা মানতেই হয়।
(১৫ নভেম্বর, ২০২০-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন