‘আর মাইরেন না, নিউজ করবো না‘ এই কথাটিকে সমসাময়িক সাংবাদিকতার বাস্তবতা বলে বর্ণনা করলে অনেকেই রুষ্ট হবেন। কিন্তু, চট্টগ্রামের সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার অসহনীয় শারীরিক পীড়নে নিউজ করার মূল্য দিতে গিয়ে অপহরণকারীদের হাত থেকে ছাড়া পেয়েও শুধু ওই একটি কথাই মন্ত্রের মত উচ্চারণ করেছেন। তিনি এমন অনিয়ম-অন্যায়ের খবর প্রকাশ করেছেন, যা চট্টগ্রামের একজন মন্ত্রীর পরিবারের রোষের কারণ হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের ইলিয়াস হোসেন কোনো মন্ত্রী-এমপির
বিরুদ্ধে লেখেন নি, স্থানীয় প্রভাবশালীদের বেআইনী গ্যাস সংযোগের ব্যবসার তথ্য প্রকাশ করার
পর ‘আর মাইরেন না, নিউজ করবো না‘ বলারও সুযোগ পাননি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সংকলিত পরিসংখ্যান বলছে চলতি
বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে অন্তত ২১৯ জন সংবাদকর্মী হামলার শিকার হয়েছেন।
করোনা মহামারির প্রকোপের
আগে দেশে হঠাৎ করেই যে জুয়ার আখড়া বা ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানো হয়েছিল তখন মহিলা
আওয়ামী লীগ নেত্রী পাপিয়ার সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী নেতা-নেত্রীদের ঘনিষ্ঠতার নানা
কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে। ক্ষুব্ধ সাংসদ সাইফুজ্জামান শিখর মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর
রহমান চৌধুরী এবং পক্ষকাল পত্রিকার সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা
আইনে মানহানির মামলা করেন। কিন্তু, মামলায় গ্রেপ্তারের আগেই তিনি তাঁর অফিসের সামনে
থেকে অপহৃত হন। ৫৩ দিন গুম হয়ে থাকার পর ভাগ্যক্রমে ছাড়া পেলেও এখনও তিনি কারাগারে।
সাংবাদিক কাজলের দূর্ভোগের
বিবরণ দিতে হলে এই নিবন্ধে অন্য আর কিছুই লেখার জায়গা হবে না। শুধু এটুকু না বললেই
নয় যে গুমকারীরা ছেড়ে দেওয়ার পর ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারের বিরল রেকর্ডটি পুলিশ তাঁর ক্ষেত্রেই
করেছে। আবার, একইভাবে ৫৪ ধারায় জামিন হওয়ার পর অন্য মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা না থাকলেও
সেই পরোয়ানা আদালতের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে। এপর্যন্ত তাঁর জামিনের
আবেদন নাকচ হয়েছে ১৩ বার। কাজলের যে ছেলে, মনোরম পলক বাবার মুক্তির জন্য একাকী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, আমাদের সেই উত্তরাধিকারীকে শিখতে হচ্ছে, ‘আর --- না, নিউজ করবো না‘।
দেশের সর্বাধিক পঠিত এবং সমাদৃত বাংলা ও ইংরেজি দুটি
সংবাদপত্র – প্রথম আলো এবং ডেইলি
স্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা সরকারের সমালোচনা করে, দোষ খুঁজে বের করে। দোষ খুঁজে
বের করা বা সমালোচনার কোনোটাই কোনো বিদ্বেষ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নয়। বরং,
জনস্বার্থ রক্ষা এবং সংশোধনের লক্ষ্যে। অথচ, তারা এতোটাই বিরাগভাজন হয়েছে যে
সাতবছরেরও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে এই দুটি পত্রিকার কোনো সাংবাদিকের প্রবেশাধিকার
নেই। পত্রিকার ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতাদের অনেকের প্রতিই আছে
পত্রিকাটিকে বয়কটের অঘোষিত নির্দেশনা। দু‘জন সম্পাদকের মোট মামলার সংখ্যা প্রায় দেড়শো। একমাত্র পাঠকপ্রিয়তাই
এই পত্রিকা দুটিকে এখনও টিকিয়ে রেখেছে। অবশ্য এই টিকে থাকাকেই ডেইলি ষ্টার সম্পাদক
বলেছিলেন ‘লিখতে না পারার স্বাধীনতা‘।
দূর্নীতি, অনিয়ম ও ক্ষমতার
অপব্যবহারের বিষয়গুলো প্রকাশ থেকে গণমাধ্যমকে নিবৃত্ত করাই যে এধরণের নিয়ন্ত্রণ ও নিবর্তনের
কারণ, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সিএনএনএর গণমাধ্যম বিষয়ক সংবাদদাতা ব্রায়ান স্টেলটার
এর কথা ধার করে বলতে হয় যে ‘তাঁরা চান না আমরা কোনো সংবাদ সংগ্রহ করি, বরং তা যেন আড়াল করি‘ (দে ডু নট ওয়ান্ট আস টু কাভার নিউজ, বাট টু কাভার আপ) । অন্যায়-অনিয়ম
আড়াল না করার অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গত জুন মাস পর্যন্ত ৫৩ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে
মামলা হয়েছে বলে পুলিশকে উদ্বৃত করে জানিয়েছে ডেইলি স্টার। স্টারের নিজস্ব হিসাবে এবছরের
অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনে আটক হয়েছেন ৩৮ জন সাংবাদিক। তাঁদের মধ্যে কতজন জেলে আছেন,
আর কতজন জামিন পেয়েছেন তা অবশ্য বলা মুশকিল।
কার্যকর গণতন্ত্রে সংবিধানপ্রদত্ত
নিশ্চয়তার আলোকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুরক্ষায় সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমকর্মীদের আদালতের
কাছে সুরক্ষা লাভের প্রত্যাশা থাকে। অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার ভরসা থাকে। জাতিসংঘ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতার একটি দিবস পালন
করে থাকে ২ নভেম্বর। এবার সেই দিবসে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনিস্টিটিউট (আইপিআই) বলেছে
গত একবছরে (অক্টোবর পর্যন্ত) এশিয়ায় দুটি দেশে সাংবাদিক হত্যার কোনো তদন্ত হয়নি – যার একটি হচ্ছে কম্বোডিয়া এবং অন্যটি
বাংলাদেশ। আর, ২৮ অক্টোবর সিপিজে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার বিচারহীনতার যে সূচক
প্রকাশ করেছে, তাতে বিচারহীনতার শীর্ষে থাকা দশটি দেশের দশ নম্বরটি হচ্ছে বাংলাদেশ।
সিপিজের হিসাবে ২০১০ থেকে ২০২০ – এই এক দশকে বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার সাতটি ঘটনার কোনো বিচার হয়নি।
মন্ত্রীদের অনেকেই মাঝেমধ্যে
বলে থাকেন যে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে গণমাধ্যম যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে। দূর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা হচ্ছে সারা বিশ্বেই গণতন্ত্রের
যে ক্ষয়সাধন ঘটছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যেভাবে সংকুচিত হচ্ছে, বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন
সাংবাদিকতার ঝুঁকি যেভাবে বাড়ছে তাতে বাংলাদেশের মত র্দূদশাগ্রস্ত আরও কিছু দেশের নাম
বলা যাবে। মানতেই হবে চলতি শতাব্দীতে স্বাধীন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি নির্বাচিত হওয়ার আগেই ২০১৬
সালে সাংবাদিকদের সুরক্ষায় কাজ করছে যেসব সংগঠন, তার অন্যতম কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস
( সিপিজে) মি ট্রাম্পকে সাংবাদিকতার শত্রু হিসাবে অভিহিত করেছিল। তবে, ট্রাম্পের রাজত্বে
সাংবাদিকরা গালি-গালাজ, অনলাইনে হুমকি ও হয়রানি কিম্বা তাঁর সমর্থকদের লাঞ্চনার শিকার
হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁদের ওপর কোনো চাপ তৈরি করা হয় নি। সেটা যুক্তরাষ্ট্রের আইনে
সম্ভব নয়।
উদার গণতন্ত্র থেকে কীভাবে
কর্তত্ববাদের দিকে বিশ্ব এবং আমরা ধাবিত হচ্ছি, তার ওপর গত ২৮ অক্টোবর সুইডেনের ভিডেম
ইনিস্টিটিউট এক নতুন রির্পোট ও সূচক প্রকাশ করেছে। এই রিপোর্টে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সময়কালে
বিশ্বে উদার গণতন্ত্রের কতটা ক্ষয়সাধন হয়েছে, তা দেখানো হয়েছে। হতাশাজনক তথ্য হচ্ছে
বিশ্বের ১৭৯টি উদার গণতন্ত্রের এই সমীক্ষায় বাংলাদেশের অবনমন ঘটে অবস্থান দাঁড়িয়েছে
১৫৪তে। উদার গণতন্ত্রের এই অধোগতি নির্ধারণে যেসব বিষয়কে তারা গুরুত্ব দিয়েছে, তার
মধ্যে গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজের মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ বলে বিবেচিত হয়েছে।
প্রবাদ আছে বিপদ কখনো
একা আসে না। এর উৎস কী তা আমার জানা নেই। কিন্তু, এই প্রবাদের মধ্যে যে নিষ্ঠুর সত্যতা
আছে তা আমরা বেশ টের পাচ্ছি। গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সংকোচনই
সাংবাদিকতার জন্য একমাত্র বিপদ নয়। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সর্বনাশা করোনা মহামারির
ছোবল। এক অজানা এবং কল্পনাতীত হিংস্র শত্রুর ছোবলে সংবাদপত্রগুলোর অবস্থা দাঁড়িয়েছে
ত্রাহি মধুসূধন। সংক্রমণের প্রথম ঢেউ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের পদধ্বনি শোনা
যাচ্ছে। যেসব গণমাধ্যম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়েছিল, সেগুলোর তালা স্থায়ী হওয়ার আশংকাই
প্রবল।
আপাতদৃশ্যে সরকারের
নীতি হচ্ছে সংখ্যার আলোকে গণমাধ্যমে বহুত্ব (মিডিয়া প্লুরালিটি) উৎসাহিত করা। তাঁদের
যুক্তিতে সংখ্যাধিক্যই হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের
স্বাধীনতার প্রমাণ। কিন্তু, অর্ন্তনিহিত উদ্দেশ্য প্রধানত
দুটো। প্রথমত: একই কথা বা ভাষ্যের বহুল পুনরাবৃত্তির
মাধ্যমে মানুষকে গণমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা, যেকারণে অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে
দলীয় আনুগত্যই ছিল প্রধান বিবেচ্য।দ্বিতীয়ত:এগুলোর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সংকোচনের মাধ্যমে
সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভরশীল করে ফেলা। এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলার লড়াই সহসা
শেষ হবে না। তবে, শেষ কথা হচ্ছে গণতন্ত্রের ক্ষয় রোধ করে যতদিন না তার পুনরুজ্জীবন ঘটানো
যাবে, ততদিন গণমাধ্যমকে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। মার খেয়েও বলতে হবে, আপস নয়, খবর ছাপব।
(৫ নভেম্বর, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন