সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

জনপ্রশাসন : জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে সমস্যা কোথায়

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল টিআইবির সমীক্ষা অনযায়ী মহামারির সময়েও দেশের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষের কাছে সরকারের আর্থিক সহায়তা পৌছায়নি। প্রশাসনের ব্যর্থতাই যে এর প্রধান কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশাসনের সর্বনিম্ন পর্যায় উপজেলা থেকে সাহায্য যাঁদের প্রাপ্য তাঁদের তালিকা হয়েছে এবং তা জেলা প্রশাসকরা যাচাই করেছেন। কিন্তু, তারপরও দেখা গেছে তালিকায় গোলমাল। র্দূদশাগ্রস্ত লোকজনের কাছে যাতে নগদ সহায়তা পৌঁছানো যায়, সেজন্যে সচিবদের সুপার-ডিসি বা জেলা গর্ভণরের মতো বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হলেও গত ছয়মাসেও সমস্যার সমাধান হয়নি। অথচ, আমাদের প্রশাসন নাকি জনমূখী। সংকটের কালে জনগণের কাছে প্রয়োজনীয় সেবা পৌঁছে দিতে না পারলেও প্রশাসনের কর্তাব্যাক্তিদের বেতন-ভাতা কিম্বা সুযোগ-সুবিধায় কিন্তু কোনো কাটছাঁট হয়নি, সেজন্যে সরকারের সম্পদেও টান পড়েনি।

মানুষের কাছে সেবা পৌঁছানোয় প্রশাসনের সমস্যাটা কোথায়? প্রশ্নটা গুরুত্বর্পূণ। সেকারণে, এবিষয়ে নানাধরণের গবেষণা এবং সংস্কারও হয়েছে। অতীতের থানা পরিষদ হয়েছে উপজেলা পরিষদ, যেখানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বিশেষ ভূমিকা আলাদা করে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। মহকুমার বিলোপ ঘটেছে, কিন্তু জেলার আয়তন কমে সংখ্যা বেড়েছে। প্রশাসনেরএকটি স্তর কমলেও আমলাতন্ত্রের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য বদলায়নি।

প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে মাঠপর্যায়ের প্রশাসনের ওপর পরিচালিত সমীক্ষা ও গবেষণায় যেধরণের চিত্র দেখা গেছে, এখনও সেই একইধরণের অবস্থার কথা শোনা যায়। কয়েকদিন আগে হাতে এসেছে সদ্য প্রকাশিত একটি বই সার্কেল অফিসার এক্সপেরিমেন্ট অব রুরাল ডেভলেপমেন্ট ১৯৬২-১৯৮২। আশির দশকে উপজেলা পদ্ধতি চালুর কারণে আমাদের অনেকের কাছেই সার্কেল অফিসার কথাটা একেবারেই অপরিচিত। সংক্ষেপে এঁদের বলা হতো সিও, যা বর্তমানের উপজেলাগুলোর প্রধান নির্বাহী ইউএনওদের সমতুল্য।  সিওদের দায়িত্ব, কাজের ধরণ এবং তাঁদের যেসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হতো সেগুলোর বিষয়ে গবেষণা করে লেখক ড. সজল দত্তগুপ্ত বইটিতে লিখেছেন যে উন্নয়ন কাজের সমন্বয়ে নিয়োজিত সিওরা তাঁদের সমস্যা মোকাবরলায় উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভূমিকায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। এর অন্যতম কারণ ছিল উর্ধ্বতন কর্তাদের সিদ্ধান্তগ্রহণে রাজনীতির প্রভাব। ফলে লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে সম্পদ বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি ও টানাপোড়েন লেগেই থাকতো। প্রয়োজন ছাড়া সেতু নির্মাণ কিম্বা বছরের পর বছর রাস্তা তৈরি না করে সেতু বানিয়ে ফেলার যেসব খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়, তাতে বোঝা যায় সেই ধারা এখনও সচল আছে।  

ইউএনওদের দায়িত্ব এবং কাজের পরিধি যে সিওদের চেয়ে আরও অনেকমাত্রায় বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে, গ্রামাঞ্চলে প্রশাসনের প্রতিনিধি হিসাবে সিওদের ভূমিকাও ছিল ব্যাপক পরিসরে বিস্তৃত। দারিদ্র মোকাবিলায় প্রধানত কৃষির উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা ও গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন এবং সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার বিষয়গুলোই ছিল তখন সিওদের কাজের বিষয়।

বইটিতে আলোচিত সমীক্ষায় দেখা গেছে ৪৮ শতাংশ সার্কেল অফিসারই বলেছিলেন সিদ্ধান্তগ্রহণে শ্লথগতির কারণ হচ্ছে ওপরের নির্দেশনার অভাব। উর্ধ্বতন কর্তাদের কাছ থেকে সময়মতো প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মেলে না। তাঁদের মাঠ পর্য়ায়ে নিয়মিত পরিদর্শনের মানে দাঁড়ায় কিছু রেজিষ্ট্রারে সই করা, ফাইলপত্র দেখা এবং মধ্যাহ্নভোজের সময় স্থানীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলা। মাঠপর্যায়ের এসব কর্মকর্তা উর্ধ্বতন কর্তাদের তুষ্ট করতেই বেশি উৎসাহিত হন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তাঁদের কাজে বাধা হয়ে যাওয়ার ধারাও একইভাবে অব্যাহত আছে। এধরণের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে মাঠপর্যায়ের আমলারা যে দ্বন্দ্বর্পূণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন, তাতে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁদের সহায়তায় খুব একটা এগিয়ে আসেন না।

তখনকার সমীক্ষাতেও থানা পর্যায়ে দূর্নীতি যে উন্নয়নের একটা অনুষঙ্গ হয়ে ছিল, তারও একটা চিত্র বইটিতে পাওয়া যায়। ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না, জনমনের এই ধারণার যথার্থতা সিওরা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তবে, তাঁদের কথায় দূর্নীতিতে মূলত তাঁদের অধস্তনরাই জড়িত। ঘুষের লেনদেন উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন শ্লথ হওয়ার অন্যতম কারণ। সেই দূর্নীতি এখন কতটা বিস্তৃত হয়েছে তার একটা চিত্র ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সর্বসাম্প্রতিক সমীক্ষাতেই উঠে এসেছে। মহামারির সময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যে পরিবারপ্রতি ২৫০০ টাকার যে থোক বরাদ্দ আর্থিক সহায়তা হিসাবে সরকার ঘোষণা করেছিল, তা যে তিনভাগের এক ভাগ মানুষের কাছে পৌঁছেছে, তাঁদের সে টাকা পেতে খরচ করতে হয়েছে ২২০ টাকা। সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও যে একইধরণের দূর্নীতি ঘটে, তাও বিভিন্নসময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে, দূর্নীতি নিয়ে এখন প্রশাসনের কোনো মাথাব্যাথা নেই, কেননা তা স্বাভাবিক ও নিত্যকার বিষয় হয়ে গেছে।

মানুষের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার সক্ষমতা অর্জনের ওপর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচির সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে। কিন্তু, মহামারির মত জাতীয় দূর্যোগের সময়ে প্রশাসনের যে দৈন্যদশা প্রকাশ হয়ে পড়েছে, তাতে শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের সুযোগ-সুবিধা আর ক্ষমতা না বাড়িয়ে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি। আর সে্ই কাজে অতীতের অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন গুরুত্বর্পূণ। জনপ্রশাসন নীতিমালা নিয়ে যাঁরা কাজ করেন নবতরঙ্গ প্রকাশনীর এই বইটি তাদের কাজে আসবে।

(২০ নভেম্বর, ২০২০-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime in N

একটি জরিপ, নৈরাশ্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্ন

উন্নত গণতন্ত্রে সরকার , সরকারপ্রধান, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল এবং বিভিন্ন বিতর্কিত ইস্যুতে প্রায়ই জনমত জরিপ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কখনো বিশ্ববিদ্যালয়, কখনো সংবাদমাধ্যম, আবার কখনো বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এসব জরিপ করায়। বেশ কিছু পেশাদার জরিপকারী প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা শুধু জরিপের কাজ করে। এসব জরিপ আমাদের গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন ভোটের মতো নয়, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শুধু সেই ওয়েবসাইটের নিয়মিত ব্যবহারকারীদের মতামত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের দেশে গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের প্রায় দুই দশক বার্ষিক জরিপে রাজনীতির গতিপ্রকৃতির চমৎকার প্রতিফলন দেখা যেত। কিন্তু গণতন্ত্রের ক্ষয়সাধনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়িক প্রয়োজন ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে জরিপ করতে গেলে সরকারের সায় আছে কিনা সেটা দেখা হয়, নইলে পেশাদার বিশেষজ্ঞরা বা তাঁদের প্রতিষ্ঠানগুলো ওই দায়িত্ব নিতে চান না। কথা বলার ভয়ের মতো মতামত জানতে চাওয়াতেও এক ধরনের ভয়ের আসর পড়েছে। গণতন্ত্র প্রসারে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট, আইআরআই এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তারা এখনো মাঝে মধ্যে স্পর্শকাতর রাজন

ভিসা নিষেধাজ্ঞা গুরুতর, সাংবাদিক নির্যাতন কী

একই দিনের দুটি সংবাদ শিরোনাম, ’৯ মাসে ২১৭ সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার: আইন ও সালিশ কেন্দ্র’ এবং ’পিটার হাসের বক্তব্য স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর চাপ, সমাবেশে সাংবাদিকনেতারা’। দুটো খবরই সাংবাদিকতা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে। তবে একটি খবর, যাতে আছে সেই সব সাংবাদিকদের কথা, যাঁরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে শারীরিক ক্ষতি অথবা গ্রেপ্তার ও মামলার কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন; আর অন্যটিতে ভবিষ্যতে কোনো গণমাধ্যমকর্মী যুক্তরাষ্ট্র যেতে চাইলে ভিসা না পাওয়ার কারণে তিনি বা তাঁর যে সম্ভাব্য ক্ষতি হতে পারে, তা নিয়ে আশঙ্কা। সাংবাদিকদের নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়ে গবেষণার কাজ ও তা প্রকাশের দায়িত্ব পালন করেছে একটি মানবাধিকার সংগঠন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসার দুশ্চিন্তায় প্রতিবাদী হয়েছেন সাংবাদিকদের অপেক্ষাকৃত নতুন একটি প্লাটফর্ম জাস্টিস ফর জার্নালিস্ট।  বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিয়মিত কাজের একটি হচ্ছে বিভিন্ন নিপীড়ন–নির্যাতন ও হয়রানির মত অধিকার লংঘনের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তারই অংশ হিসাবে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ পেশা সাংবাদিকতার ওপর তাদের আলাদা মনোযোগ। তাদের প্রকাশিত হিসাব