সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ধর্ম, রাজনীতি ও গণ-উন্মাদনা

 নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে গণলাঞ্ছনা ও সাভারের  আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে হত্যার ঘটনা দুটি নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছে। তবে তা সীমিত আকারের বলেই মানতে হবে। নাগরিক সমাজের প্রগতিশীল অংশই মূলত এ সব প্রতিবাদের উদ্যোক্তা ও অংশগ্রহণকারী। শিক্ষকদের পেশাদার সংগঠনগুলোর কয়েকটিও প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে তা-ও খুব জোরালো কিছু নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিবাদ আরও ক্ষীণ। প্রধানত, বামপন্থী দলগুলোই এবিষয়ে সরব হয়েছে। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো কার্যত নীরব - ধারণা করি, কৌশলগত কারণে।  


কৌশলগত কারণ অবশ্য একটি নয়, একাধিক। সেগুলো কী হতে পারে? প্রথমতঃ ধর্মের প্রশ্ন জড়িত থাকলে ভোটের রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল দলগুলো নেতৃত্বের ভূমিকা নেওয়ার চেয়ে জনপ্রতিক্রিয়া দ্বারা চালিত হওয়াকেই নিরাপদ বিবেচনা করে। তবে দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হচ্ছে, ধর্ম বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের জন্যই সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয়। নড়াইলের ঘটনা কিম্বা তারও আগে মুন্সীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে হিন্দু শিক্ষক লাঞ্ছনার নজিরগুলোর কথা এখানে স্মরণ করা যায়। নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, সংখ্যালঘুদের ভরসা বলে কথিত রাজনৈতিক দলও এর ব্যতিক্রম নয়। 


আপাতদৃশ্যে দেশে ধর্মের চর্চা বেড়েছে বলে কেউ কেউ যুক্তি দেন যে তার অনুষঙ্গ হিসাবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে সাম্প্রদায়িক প্রবণতাও তৈরি হচ্ছে। তবে সাম্প্রদায়িক প্রবণতা যেখানেই দৃশ্যমান হচ্ছে, সেখানেই নেপথ্যে রাজনীতির যোগসূত্রের অভিযোগ মেলে। আর তার সঙ্গে আছে রাজনীতির একচেটিয়াবাদ - ক্ষমতা নিরংকুশ করার প্রবণতা।  


দ্বিতীয় যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলো মৌনতার নীতি অনুসরণ করে, তা হচ্ছে স্কুল-কলেজে এ ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার পিছনেও আছে প্রাধান্য বিস্তারের রাজনীতি। দলীয় লোকদের ক্ষমতায়িত করা কিম্বা সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্য থেকেই কথিত বাধা অপসারণের জন্যই এ ধরনের দলাদলি ও নোংরামির ঘটনা ঘটানো হয়। নড়াইলের ঘটনার যেসব বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, অধ্যক্ষের শূণ্য পদটি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যেই একধরণের ঠান্ডা লড়াই চলছিল এবং তাতে স্থানীয় রাজনীতিরও প্রত্যক্ষ অথবা প্রচ্ছন্ন ভূমিকা রয়েছে। এসব বিবরণ প্রকাশ হয়ে পড়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্থানীয় কমিটি থেকে একজনকে বহিষ্কারও করেছে, যিনি স্বপন কুমার বিশ্বাসের একজন সহকর্মী। অন্যদিকে সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল সরকারকে হত্যায় অভিযুক্ত কিশোর প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের সভাপতির নাতি (শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা: সেই ছাত্রের নানা স্কুলের সভাপতি চাচা পরিচালক, বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ জুন, ২০২২)।, 

 

রাজনৈতিক দল ও ব্যাক্তির ভূমিকা বোঝার জন্য গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি সম্ভবত নারায়ণগঞ্জের। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ২০১৬ সালের ১৩ মে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কান ধরে ওঠবস করানো হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের উপস্থিতি ও ভূমিকার কারণেই সেদিন শ্যামল কান্তি ভক্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পরে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্তও করেছিল । প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। কিন্তু অলৌকিকভাবে মামলায় আদালত তাঁকে অব্যাহতি দেন। শ্যামল কান্তির জন্য তখন অবশ্য সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী সংসদে নিন্দা জানিয়েছিলেন। স্বপন কুমার বিশ্বাসের বেলায় তেমনটি ঘটেনি।  


শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে অনেকদিন আগেই। আগে দেখা হতো, আমাদের (দলের) লোক কি না। এখন দেখা হয়, আমার লোক কি না। এই আমার মানে হচ্ছে সংসদ সদস্যের। সরকারি নীতিমালায় স্কুল-কলেজের পরিচালনা পরিষদ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো এলাকার সংসদ সদস্যের। তিনি নিজে না হলেও তাঁর সম্মতি ছাড়া কেউ তাঁর এলাকার স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন, এমন কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি ওই কমিটিতে অভিভাবক প্রতিনিধি কিম্বা শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনেও তাঁদের পছন্দই প্রধান হয়ে ওঠে। 


স্কুল-কলেজের নিয়ন্ত্রণ সংসদ সদস্যের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন নির্বাচনে শিক্ষকদের ভূমিকার কারণে। শিক্ষকরা সাধারণত সব নির্বাচনেই ভোট গ্রহণের কাজে নিযুক্ত হন এবং তাঁদের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিষয়টি তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রাজনীতিকদের ক্ষমতার সমীকরণে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পরিষদের যোগসূত্রকে উপেক্ষা করে শিক্ষকদের নাজেহাল হওয়ার সমস্যাটি পরোপুরি বোঝা যাবে না। সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা যেমন আছে, তেমনই আছে রাজনীতির ভূমিকা। 


রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি আরও গুরুতর হয়ে ওঠে যখন দেখা যায় প্রশাসনও হয় নির্বিকার, নয়তো ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছে। নড়াইলের ঘটনায় ভুক্তভোগী স্বপন কুমার সরকারের জবানিতে আমরা জেনেছি, ``একপর্যায়ে জেলা প্রশাসকও কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত হন। বিকেল চারটার দিকে হ্যান্ডমাইকে জুতার মালা পরানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। এ সময় শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস এবং ওই শিক্ষার্থী কলেজের ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে ছিলেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁদের কক্ষটি থেকে বের করা হয়। নিচতলার কলাপসিবল গেটের সামনে আনার পর গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেওয়া হয়`` ( বললেন নড়াইলের সেই শিক্ষকঃ‘মনে হয়েছিল আত্মহত্যা করি’, প্রথম আলো, ২৯ জুন, ২০২২)। কলেজ প্রাঙ্গণে জেলা প্রশাসকের উপস্থিতিতে অধ্যক্ষ কীভাবে গণলাঞ্ছনার শিকার হলেন,তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নেই। জেলার শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা কলেজে গিয়ে অধ্যক্ষের কক্ষে না গিয়ে অন্য কোথাও যাবেন, তা তো হওয়ার কথা নয়। স্থানীয় থানার দারোগার তাৎক্ষণিক বদলি হয়, কিন্তু জেলা প্রশাসক শুধু স্বপদে বহালই থাকেন না, তিনিই প্রশাসনিক তদন্তের কমিটি করেন। তদন্ত প্রতিবেদনও জমা পড়বে তাঁর কাছে। গত দুই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের জন্য আমলারা যা করেছেন, তার প্রতিদান হিসাবে তাঁরা যে এখন মোটামুটি জবাবদিহির উর্ধ্বে উঠে গেছেন, এ সব ঘটনা তেমন দাবিকেই জোরদার করে। 


অতীতে শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিকর্মী, নেতৃস্থানীয় নাগরিকরা এ ধরনের ঘটনায় যত দ্রুত ও যে মাত্রায় তৎপর হতেন, প্রতিবাদ সংগঠিত করতেন, এখন আর তা দেখা যায় না। দু-একটি বিবৃতি দেওয়া এবং মানব বন্ধন হলেও তাতে ক্ষমতাসীন সরকারকে বিব্রত না করার জোর চেষ্টা থাকে। কথিত সাম্প্রদায়িক শক্তিকে দায়ী করেই দায় শেষ। অথচ সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্রমশ দানবীয় রুপ নিচ্ছে, সেকথা অনুচ্চারিত থাকে। সংখ্যালঘু অথবা সংখাগুরু নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা ও ব্যাক্তির মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব যে সরকারের, তার জবাবদিহির যেন কোনো প্রয়োজন নেই। অভিযুক্তেরও যে বিচার পাওয়ার অধিকার আছে, তা উপেক্ষা করা হয়। গণপিটুনি কিম্বা কথিত গণআদালতের রায় তো কখনো শেষ কথা হতে পারে না। কোনো গণতন্ত্র বা আইনের শাসন তা অনুমোদন করে না। আমাদের সমাজের অগ্রসর অংশের অনেকেই অবশ্য রাজনৈতিক কারণে এ ধরনের গণ-উন্মাদনায় উৎসাহ দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ধর্মকে ব্যবহার করে গণ-উন্মাদনা তৈরির সংস্কৃতির দায় তাঁরা কীভাবে এড়াবেন? 


(৭ জুলাই, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...