ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যের স্থায়ী রাজনৈতিক বিচ্ছেদ বাস্তবায়নের নায়ক হিসেবে সমর্থকদের কাছে পরিচিত প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের তাসের ঘর যেভাবে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার কম সময়ে ভেঙে গেল, তার প্রভাব তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচনে বেশ ভালোই অনুভূত হচ্ছে। দলের যে এমপিরা ঠিক এক মাস আগে গত ৭ জুন তাঁর বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন, সেই সতীর্থরাই যেভাবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় তাঁকে প্রকাশ্যে পরিত্যাগ করতে শুরু করলেন, তাকে অনেকেই ডুবন্ত জাহাজ থেকে ইঁদুরদের লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টার সঙ্গেও তুলনা করেছেন। আগামী নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টির সেই সম্ভাব্য ভরাডুবি থেকে রক্ষা করার জন্য যাঁরা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তাঁদের মধ্যে কে সফল হবেন, তা এখনই হয়তো নিশ্চিত করে বলা যাবে না। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এখন পর্যন্ত যে দুজন সবচেয়ে এগিয়ে আছেন, তাঁদের একজন হলেন বরিসের পতন ত্বরান্বিত করার প্রধান ভূমিকা পালনকারী দ্বিতীয় পদত্যাগী মন্ত্রী ঋষি সুনাক। অপরজন পেনি মরড্যান্ট, যিনি বরিসের মন্ত্রিসভায় কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকায় প্রধানমন্ত্রীর অনৈতিক কাজকর্মের দায় তাঁর ওপর খুব একটা বর্তাচ্ছে না।
যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন পাবেন, তিনিই প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ধারণা চালু থাকলেও ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলোয় দলের নেতারাই প্রধানমন্ত্রী হন এবং দলের নেতা নির্বাচন করেন দলের সাধারণ সদস্যরা। তবে এমপি নন, এমন কেউ দলের নেতা হন না। কনজারভেটিভ পার্টির দলীয় বিধি অনুযায়ী এমপিরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজটা সম্পাদন করেন এবং সাধারণ সদস্যদের ভোটের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুজন নামিয়ে আনেন। এই বাছাইপ্রক্রিয়া এবং এমপিদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় মন্ত্রীদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরোটাই সাধারণ এমপিদের হাতে, যাঁদের ব্যাকবেঞ্চার বলা হয়। তাঁদের একটি কমিটি আছে, যা ১৯২২ কমিটি নামে পরিচিত। এই ১৯২২ কমিটি এবার ঠিক করেছিল, অন্তত ১৫ জন এমপির সমর্থন ছাড়া কেউ প্রার্থী হতে পারবেন না। এরপর পালাক্রমে অন্য এমপিরা ভোট দিয়ে কম ভোট পাওয়াদের বাদ দিতে দিতে শেষ দুজনকে দলের সাধারণ সদস্যদের কাছে তুলে ধরবে।
গত বুধবার প্রথম দফা ভোটে ২০টির কম ভোট পাওয়ায় বাদ পড়ে যান বরিসের পতন ত্বরান্বিত করার পালায় প্রথম পদত্যাগকারী স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ, দলীয় নেতৃত্বে বরিসের সাবেক প্রতিদ্বন্দ্বী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট ও বরিসের মন্ত্রিসভার সর্বশেষ অর্থমন্ত্রী নাদিম জাহাউয়ি। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় দফা ভোটে কমপক্ষে ৩০ জনের সমর্থন প্রয়োজন বলে পূর্বনির্ধারিত শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ঝরে পড়েন বরিস জনসনের প্রতি শেষ পর্যন্ত অনুগত থাকা অ্যাটর্নি জেনারেল সুয়েলা বেভারম্যান। সুয়েলা বেভারম্যান ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে সবচেয়ে কট্টর ব্রেক্সিটপন্থী। নারী ও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর একজন হিসেবেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রতিযোগিতা থেকে এত তাড়াতাড়ি তাঁর বিদায় ইঙ্গিত দেয় ভোটের হিসাব-নিকাশ খুব সোজাসাপটা নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এমপিদের ভোটে এগিয়ে থাকা ঋষি সুনাকের বিপরীতে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাসের সম্ভাবনা সুয়েলার চেয়ে উজ্জ্বল গণ্য করেছেন বরিসের ঘনিষ্ঠজনরা।
দ্বিতীয় দফা ভোটে অবশ্য লিজ ট্রাস আশানুরূপ সাফল্য পাননি। তাঁর ভোট সামান্য বেড়েছে, অথচ ধারণা করা হচ্ছিল, তিনি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় দলের কট্টর ডানপন্থীদের সমর্থন আদায় করতে পারবেন ও তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করবেন। কিন্তু কট্টর ডানপন্থীদের ভোট সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন উঠতি তারকা পেনি মরড্যান্ট ও কেমি বেডনক। এই পর্বে ঋষি সুনাক ১০১ ভোট পেয়ে প্রথম এবং ৮৮ ভোট পেয়ে পেনি মরড্যান্ট আছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের মধ্যে পরিচালিত ইউগভের মতামত জরিপ বলছে, পেনি মরড্যান্ট ঋষি সুনাকের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি ভোট পাবেন। এখন টিকে থাকা পাঁচজনের অপর চারজনের প্রত্যেকের বিপক্ষেই দলের সদস্যরা পেনি মরড্যান্টকে দেড় থেকে দ্বিগুণ ভোটে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
ঋষি সুনাক ও লিজ ট্রাস ছাড়া অন্য যে দুজন—কেমি বেডনক ও টম টুগেনহাট, তাঁরা রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নতুন। টুগেনহাট কখনো সরকারের কোনো পদে ছিলেন না, তবে পররাষ্ট্রবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি হিসেবে সরকারের ওপর তাঁর যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি একজন সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করেছেন। সততা এবং জনগণের আস্থা অর্জনকেই তিনি তাঁর প্রধান অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরেছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই এখন আশা করছেন, টিভি বিতর্কে তাঁরা নিজেদের অবস্থান যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারলে দলীয় সদস্যদের মন জয় করা সম্ভব হবে। আজ শুক্রবার, আগামী রোববার ও সোমবার তিনটি টিভি বিতর্ক হওয়ার কথা আছে এবং দ্বিতীয় ভোটে টিকে যাওয়া পাঁচজনই সেদিক থেকে ভাগ্যবান।
ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ, জ্বালানিসংকট ও মূল্যস্ফীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ, ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের কারণে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সরকার পরিচালনায় অচলাবস্থা, স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট দাবি এবং রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নগুলো প্রার্থীদের আলোচনায় এখনো সেভাবে সামনে আসেনি। বরং ঋষি সুনাক অর্থমন্ত্রী হিসেবে যেসব কর বাড়িয়েছেন, বিশেষ করে করপোরেট কর সেগুলো কমানো এবং সরকারি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, তা কমিয়ে আনার প্রশ্নই এখন অবধি প্রার্থীদের আলোচনায় অগ্রাধিকার পাচ্ছে। ঋষি ছাড়া সবাই এখনই কর কমাতে ও সরকারের আকার ছোট করতে চান। ঋষি বলছেন, তিনিও তাঁর দলের কর হার কমানোর নীতিতে বিশ্বাসী, তবে তা এখন অসম্ভব। কর এখন কমালে সরকার কোত্থেকে ব্যয় মেটাবে, তার পরিকল্পনা ছাড়া অন্যদের অঙ্গীকার বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলেই তাঁর দাবি।
ঋষি এমপিদের ভোটে এগিয়ে থাকলেও তার অতীত ও ব্যক্তিগত জীবন এখন সবার নজরে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় প্রযুক্তি কোম্পানি ইনফোসিসের প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণমূর্তির মেয়ে অক্ষতা মূর্তির স্বামী পরিচয়ের জন্যও তাঁকে বাড়তি প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী মিলে ৭৩ কোটি পাউন্ডের (প্রায় শত কোটি ডলার) মালিক। ব্যক্তিজীবনে বিনিয়োগ ব্যাংকে চাকরির সুবাদে আমেরিকায় থাকার সময় তিনি গ্রিনকার্ড নেন এবং মাত্র বছর কয়েক আগে সমালোচনার মুখে তিনি তা পরিত্যাগ করেন। তাঁর স্ত্রী ভারতীয় নাগরিকত্বের কারণে অনিবাসী হিসেবে যুক্তরাজ্যের বাইরের আয় ও সম্পদের ওপর কর অব্যাহতির সুবিধা নেওয়ায় গত বছর বিপুলভাবে সমালোচিত হন। পরে তাঁর স্ত্রী তখন থেকে সব আয়ের কর ব্রিটেনে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ঋষির ঘনিষ্ঠ কেউ কেউ তখন অভিযোগ করেন, ভবিষ্যতে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার আশঙ্কায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তাঁর ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস করা হয়েছে। শ্রমজীবী শ্রেণির মানুষজনের মধ্যে তাঁর কোনো বন্ধু নেই—এমন বক্তব্যসংবলিত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তাঁর তরফে বলা হয়েছে, তিনি কর্মজীবীদের জন্য সর্বাধিক আর্থিক সুবিধার ব্যবস্থা করেছেন।
টিভি বিতর্কে তো বটেই, তার বাইরে পত্র-পত্রিকায় আগামী দিনগুলোয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সমর্থকেরা নানা ধরনের গোপন ও বিব্রতকর তথ্য ফাঁস করতে পারেন বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। ফলে আপাতত প্রতিদ্বন্দ্বিতার যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তা শেষ পর্যন্ত বদলে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
আর যদি এই প্রবণতা অপরিবর্তিত থাকে তাহলে রাজনৈতিক পণ্ডিতদের কথাই সত্য হবে বলে মনে হচ্ছে। আর তা হলে ব্রিটেনে প্রথমবারের মতো জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ভারতীয় বংশোদ্ভুত ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার রেকর্ডটি হবে না। ঋষি কিম্বা টম টুগেনহাট জয়ী না হলে কোনো পুরুষ প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরবেন না। যে রেকর্ড হবে, তা হলো ব্রিটেন তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী পাবে এবং তাও কনজারভেটিভ পার্টি থেকে। আগের দুজন মার্গারেট থ্যাচার ও থেরেসা মেও কনজারভেটিভ দলের নেতা ছিলেন। ঋষি এমপিদের মধ্যে অগ্রবর্তী অবস্থানে থাকলেও পিছিয়ে থাকা অধিকাংশের ভোট পেনি মরড্যান্টের দিকেই যাবে। আর দলের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে তো তিনি এগিয়েই আছেন। নৌবাহিনীতে রিজার্ভ হিসাবে কাজ করা সাবেক এই নারী নৌসেনা রাজনীতিতে আসার আগে জাদুকরের সহকারি হিসাবেও কাজ করেছেন। রাজনীতির জাদুতে ভবিষয়তে পিএম মানে আমাদের শুধু প্রধানমন্ত্রী (প্রাইম মিনিস্টার) নয়, পেনি মরড্যান্টও বুঝতে হতে পারে।
(১৫ জুলাই, ২০২২-এ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন