জাতিগত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক গণহত্যা সনদের অধীনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলাটি এখন আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে) বিচার করবে। আদালতের এখতিয়ার এবং গাম্বিয়ার আইনি অধিকারের প্রশ্নে মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তিগুলো প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি আইসিজে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর দায়ের করা গাম্বিয়ার মামলাটি গ্রহণ করেছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তি যতই সময়সাপেক্ষ হোক না কেন, গণহত্যার শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বিশ্ববাসী এখন নিশ্চিত হতে পারে যে আমরা ন্যায়বিচারের পথে এক ধাপ এগিয়েছি।
মিয়ানমারের সামরিক জান্তাও এখন বুঝতে পারছে যে এবার তাদের ওই মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধের জবাবদিহি করতে হবে। আইসিজের রায়ে মিয়ানমার সরকারিভাবে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে জান্তার এ উপলব্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনির মালিকানাধীন সংবাদপোর্টাল মায়াওয়াদিতে দেশটির আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত বিবৃতিতে এ রায়ের প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। এতে বলা হয়েছে, "মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তি আদালতের প্রত্যাখ্যান আমাদের হতাশ করেছে এবং আমরা বিবেচনায় নিচ্ছি যে আদালত মামলাটি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।" এ রায়ের গুরুত্বের স্বীকারোক্তি মেলে তার পরের বাক্যেই, যেখানে বলা হয়, "মিয়ানমার একথাও বিবেচনায় নিচ্ছে যে এই রায় শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক আইনের একটি উৎস হবে না, বরং ভবিষ্যতের মামলাগুলির জন্য একটি নজিরও স্থাপন করবে।" বিবৃতিতে যোগ করা হয়েছে, "মিয়ানমার গণহত্যা সনদ অনুসমর্থনের বিষয়ে তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করার ঘোষণা দিচ্ছে এবং কোনোধরণের লঙ্ঘন বা বিচ্যূতি ছাড়াই সনদের বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলবে।"
মন্ত্রণালয় তার বিবৃতিতে অবশ্য মুখরক্ষার চেষ্টায় একথাও যোগ করেছে যে, 'মিয়ানমার তার সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে এবং দেশের পক্ষে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রাখবে।' মামলায় প্রাথমিক আপত্তি পেশের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়,, আইনের জোরালো ভিত্তি এবং শক্তিশালী তথ্য-প্রমাণ রয়েছে, এমন বিশ্বাস থেকেই মিয়ানমার সরকার প্রাথমিক আপত্তিগুলি উত্থাপন করেছিল। এ প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বিচারপতি শোয়ে হ্যানকিনের ভিন্নম্তের কথাও উল্লেখ করা হয়। মামলা করায় গাম্বিয়ার আইনি অধিকার এবং মামলাটি শুনানির গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে বিচারপতি শোয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন।
মিয়ানমার আদালতের এখতিয়ার এবং আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে চারটি বিষয়ে প্রাথমিক আপত্তি উত্থাপন করেছিল। প্রথম প্রাথমিক আপত্তিতে, মিয়ানমার যুক্তি দিয়েছিল যে "প্রকৃত আবেদনকারী" হচ্ছে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) ও গাম্বিয়া তার প্রতিভু এবং সেকারণে এ মামলা গ্রহণের এখতিয়ার আদালতের নেই। দ্বিতীয় প্রাথমিক আপত্তি ছিল, গণহত্যা সনদের বিধি অনুযায়ী গাম্বিয়ার এই মামলা করার অধিকার নেই। তৃতীয় প্রাথমিক আপত্তিতে মায়ানমার বলেছিল, যেহেতু মিয়ানমার গণহত্যা সনদের ৮ নম্বর ধারায় আপত্তি জানিয়েছিল, সেহেতু গাম্বিয়া এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে না এবং তাই মামলা গ্রহণে আদালতের এখতিয়ার নেই। আর চতুর্থ প্রাথমিক আপত্তিতে, মিয়ানমার দাবি করেছিল, আবেদনটি দাখিলের তারিখে দুই দেশের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না এবং সে কারণে আবেদনটি আদালতের কাছে অগ্রহণযোগ্য হবে।
আদালতে তিনটি প্রাথমিক আপত্তি সর্বসম্মতভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। মামলা করার আইনি অধিকার গাম্বিয়ার নেই বলে মিয়ানমারের যে আপত্তি, সেটি প্রত্যাখ্যাত হয় ১৫-১ ভোটে। গাম্বিয়ার মূল মামলা শুনানির জন্য গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নেও সিদ্ধান্ত হয় ১৫-১ ভোটে। আদালতের এই উভয় সিদ্ধান্তেই ভিন্নমত প্রকাশ করেন বিচারপতি শোয়ে হানকিন। তবে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে আদালতে বিবদমান পক্ষ দুটির প্রতিনিধিত্বকারী দুজন অ্যাডহক বিচারক নাভি পিল্লাই এবং ক্লাউস ক্রেস আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠের সাথে একমত পোষণ করেন। নাভি পিল্লাই গাম্বিয়া এবং ক্লাউস ক্রেস মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেন।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার বিচারের প্রক্রিয়ায় আইসিজের এ রায় সত্যিই এক বিশাল পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা যে একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া, তা আমরা সবাই জানি। এ বিচার শেষ হতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে। কিন্তু তারপরও এখন নিশ্চিত করে বলা যায় যে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্মূল অভিযানের জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা আর তাদের দায় এড়াতে সক্ষম হবে না। আইসিজের রায়ে কোনো ব্যাক্তির দায় নিরুপণ হবে না, বা অপরাধের সাজা হবে না, তবে দেশটির সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের জবাবদিহি নিশ্চিত হবে। আর তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের স্বতন্ত্র বিচারপ্রক্রিয়ার সহায়ক হবে।
এর আগে, ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারী, গাম্বিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে, আইসিজে মিয়ানমারের প্রতি সুনির্দিষ্ট কিছু সাময়িক পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনায় ছিল মিয়ানমারের ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে কোনও গণহত্যামূলক কাজ প্রতিরোধ এবং তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা । নৃশংসতার অভিযোগ-সম্পর্কিত সব সাক্ষ্য-প্রমাণ যাতে বিনষ্ট করা না হয় এবং সেগুলোর সংরক্ষণ নিশ্চিত করার জন্যও আদালতের নির্দেশনা ছিল। আর ওই সব আদেশ কার্যকর করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে প্রথমে চার মাস এবং পরে মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত ছয় মাস পরপর আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও আরোপ করেছিল আদালত।.
আইসিজে এবারের রায়ে উল্লেখ করেছে্ন যে মিয়ানমার ২০২০ সালের ২২ মে, ২০২০ সালের ২৩ নভেম্বর, ২০২১ সালের ২০ মে, ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর এবং ২০২২ সালের ২৩ মে আদালতের আদেশ কার্যকর করার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আদালত আরও জানিয়েছেন যে গাম্বিয়াও, প্রতিটি রিপোর্টের উপর তাদের মন্তব্য জমা দিয়েছে। আইসিজে তাঁর আদেশে যে শুধুমাত্র একটি দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর সুরক্ষার নির্দেশনাই দিয়েছিলেন, তা নয়। বরং ওই নির্দেশনায় রোহিঙ্গাদের একটি স্বতন্ত্র জাতিগত গোষ্ঠী হিসাবে স্বীকৃতিও মিলেছিল।
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মিয়ানমার এখন পর্যন্ত কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে এবং গাম্বিয়া কীভাবে সেগুলোর মূল্যায়ন করেছে, তা আমরা জানি না, কিন্তু আইসিজের রায়ে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমার দেখানোর চেষ্টা করছে যে আইসিজের প্রতি তারা তার বাধ্যবাধকতা পূরণে সচেষ্ট রয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে এর কোনো প্রতিফলন নেই। কারণ, ইউএনএইচসিআরের ভাষ্যমতে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গাম্বিয়া ২০২০ সালের অক্টোবরে আদালত কর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তার লিখিত আরজি পেশ করেছে। সুতরাং, আশা করা হচ্ছে, মিয়ানমারকে এখন শিগগিরই তাদের প্রতিক্রিয়া জমা দিতে হবে। আবার কানাডা এবং নেদারল্যান্ডসও রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচারের জন্য গাম্বিয়ার সঙ্গে মামলায় পক্ষভুক্ত হয়েছে। আমরা আশা করি আইনি প্রক্রিয়া এখন নতুন গতি পাবে। তাই, আইনি প্রক্রিয়া এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে মিয়ানমার জান্তার উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করারও এখন উপযুক্ত সময়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে কার্যকর ও অর্থবহ কূটনৈতিক চাপ তৈরির এ সুযোগ আমাদের সদ্ব্যবহার করা দরকার।
(২৫ জুলাই, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন