শ্রীলঙ্কায় গণঅভ্যূত্থানের পরিণতিতে সরকার বদল হয়েছে, নতুন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। কিন্তু গণ-অভ্যূত্থান যাঁরা ঘটিয়েছেন, তাঁরা তাঁকেও চা্ন না। গণরোষের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকে যেমন আন্দোলনকারীরা চান না, তেমনই তাঁরা রনিলকেও চান না। আন্দোলনকারীরা তাঁদের অর্থনৈতিক দূর্ভোগ এবং দেশটির দৈন্যদশার জন্য উভয় নেতা এবং তাদের রাজনীতিকে দায়ী করেছেন। স্পষ্টতই অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ার কারণে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটলেও তার উৎস রাজনীতির গভীরেই প্রোথিত। রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলো সংকট মোকাবিলায় যেমন কোনো পথ দেখাতে পারেনি, তেমনই শ্রীলঙ্কাবাসীর মনের ভাষাও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণে যে শিগগিরই পরিস্থিতির লক্ষ্যণীয় উন্নতি হবে, সে কথা কেউই জোর দিয়ে বলতে পারছেন না। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার হবে কি না, হলে কত দিনে এবং কীভাবে হবে, সেসব প্রশ্নের উত্তর এখন অজানা।
রাজনৈতিক সংকটকে অনেকেই গোতাবায়ার অপশাসন ও কর্তৃত্ববাদের ফল হিসাবে বর্ণনা করে চলেছেন। অথচ এই অপশাসন ও কর্তৃত্ববাদের উৎস হচ্ছে দেশটির স্বাধীনতার পর ধারাবাহিকভাবে জাতিতান্ত্রিক হয়ে ওঠা, যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলী জাতির হাতে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্রীভূত হয়েছে এবং সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়েছে। ওই সংখ্যাগুরু সিংহলী জাতীয়তাবাদের একটি ধর্মীয় মাত্রাও আছে, যা বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অন্যান্য সংখ্যালঘুদের অবদমন ও সংখ্যাগুরু সিংহলীদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার পালা শুরু হয়। শ্রীলংকা যে পতাকা নির্বাচন করে, তাকে সিংহলী শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসাবে দেখা হয় উল্লেখ করে ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রফেসর নিল ডেভোটা ফরেন পলিসি সাময়িকীতে লিখেছেন, তলোয়ার হাতে সিংহ হলো সংখাগুরুর সাহসের প্রতীক; যার মুখোমুখি থাকা ডোরাকাটা ফিতাগুলো হচ্ছে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো।
১৫ শতাংশ তামিল ও ১০ শতাংশ মুসলমান নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকে। ১৯৫৬ সালেই প্রসিডেন্ট এস ডাব্লু আর ডি বন্দরনায়েক সিংহলীকে একমাত্র জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেন । মাত্র ১৫ বছর পর দেখা যায়, তামিলদের প্রতিনিধিত্ব সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে এবং সেনাবাহিনীতে ৪০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নেমে যায়। বৈষম্য শুধু চাকরির ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে সিংহলীদের চেয়ে তামিলদের জন্য বেশি নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়।
রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতিতান্ত্রিক বৈষম্যের জবাবে তামিল তরুণরা বিচ্ছিন্নতাবাদী লড়াইয়ের পথ বেছে নেয়, যে সশস্ত্র লড়াই চলে প্রায় তিন দশকেরও বেশি, প্রাণহানি ঘটে জাতিসংঘের হিসাবে কমপক্ষে ৮০ হাজার। ওই বিদ্রোহ দমনেই মূলত রাজাপক্ষে পরিবারের রাজনৈতিক উত্থান ঘটে। তামিলদের সঙ্গে শান্তি আলোচনার বিরুদ্ধে সিংহলী জাতীয়তাবাদের শ্রেষ্ঠত্বের ঢেউ তুলে বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী ভাই গোতাবায়াকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা গোতাবায়া আবির্ভূত হন বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্নকারী ( টার্মিনেটর) হিসাবে। আগের সরকারগুলো যে বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম হচ্ছিলো, সেই বিদ্রোহ এক মেয়াদেই নিষ্ঠূর শক্তিপ্রয়োগে দমন করে রাজাপক্ষে ভ্রাতৃদ্বয় সিংহলীদের কাছে বীরের মর্যাদা লাভ করেন। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ওঠে গোতাবায়া ও সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের তদন্তে এসব অভিযোগ ওঠার পর বিচারের দাবিও প্রত্যাখ্যান করা হয়। সংখ্যালঘুবিদ্বেষী জাতীয়তাবাদই হয়ে দাঁড়ায় দেশপ্রেমের একমাত্র মাপকাঠি। শুরু হয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়া।
রাজাপক্ষে ভ্রাতাদের ক্ষমতা সংহত করার পথে সাময়িক বিপত্তি সৃষ্টি করেন মাহিন্দা রাজাপক্ষের মন্ত্রিসভায় কাজ করা মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। ২০১৫ সালে তিনি মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে নির্বাচনে জয়ী হন। তিনি প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা কমানো এবং পার্লামেন্ট ও বিচারবিভাগের হারানো ক্ষমতা পুনরুদ্ধার এবং যুদ্ধাপরাধের বিচার ও দূর্নীতি তদন্তের কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন। কিন্তু বছর তিনেকের মধ্যেই তাঁর বিরোধ বাধে তখনকার প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের সঙ্গে। তিনি রনিলকে বরখাস্ত করে মাহিন্দা রাজাপক্ষেকেই প্রধানমন্ত্রীর পদে ফিরিয়ে আনেন। রাজাপক্ষে পরিবারের আরও ক্ষমতাবান হওয়ার পথ খুলে যায় এবং ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গোতাবায়া নির্বাচিত হন। সিরিসেনার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে শ্রীলংকার রাজনৈতিক গতিপথ ভিন্নতা পেত কি না, সেই আলোচনা এখন অনেকটাই তাত্ত্বিক বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
শ্রীলঙ্কায় জাতিগত এই তিক্ত বিভাজন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নতির বাইরের মোড়কে আড়ালেই ছিল। বিপুল সংখ্যায় পর্যটক আকৃষ্ট করার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্রের কারণে অনেকেই শুধু দেশটির ইতিবাচক দিকগুলোর কথাই জানেন। কিন্তু, নিষ্ঠুর সত্য হচ্ছে দেশটির রাজনীতি নানাভাবে ও কারণে সহিংসতায় পীড়িত। অধিকাংশ হামলার জন্য তামিল বিদ্রোহী গোষ্ঠী এলটিটিই দায়ী হলেও একমাত্র তারাই যে রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত ছিল, তা নয়। আশির দশকের শেষভাগে কয়েকবছর জুড়ে সহিংসতার কেন্দ্রে ছিল বামপন্থী জনতা ভিমুক্তি পেরামুনা বা জেভিপি। ১৯৮৭ সালের ১৮ আগস্ট পার্লামেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট জে আর জয়বর্ধনে ও প্রধানমন্ত্রী রানাসিংহে প্রেমদাসা এমপিদের সঙ্গে সভা করার সময়ে জেভিপি গ্রেনেড হামলা চালালে তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, কিন্তু একজন এমপি ও সচিব নিহত হন। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের হত্যা ছাড়াও সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও শিক্ষাবিদদের হত্যার অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে। জেভিপিকেও নিরাপত্তাবাহিনী কঠোরতার সঙ্গে দমন করে।
আর তামিল বিদ্রোহীদের অভিযানগুলো তো রীতিমতো সমরবিদদের পাঠ্যবিষয়। আত্মঘাতী বোমাহামলা এই গোষ্ঠীর স্মারক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। ১৯৯৩ সালে এরকম এক হামলায় নিহত হন দেশটির তখনকার প্রেসিডেন্ট প্রেমদাসা। বিভিন্ন সময় প্রাণ হারিয়েছেন আরও অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিক ও সেনা কর্মকর্তা। তামিল গেরিলাদের মতো সামরিকবাহিনীও নিষ্ঠুরতা্র জন্য বিশেষভাবে আলোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। নজরদারি ও নিপীড়ণ কৌশলের জন্যও দেশটির নিরাপত্তাবাহিনী মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দ্বারা ব্যপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। মূলত উপমহাদেশে যে গুমের ধারার প্রচলন ঘটেছে, ব্যপকহারে তার চর্চা হয়েছে শ্রীলংকায়, যা হোয়াইট ভ্যানের শ্বেত সন্ত্রাস হিসাবে পরিচিত। সরকারি বাহিনী ছাড়াও সরকার সমর্থক বেসামরিক সশস্ত্র দল বা মিলিশিয়ারাও এধরণের অপরাধে যুক্ত ছিল। জেভিপি ও তামিল বিদ্রোহ দমনের অংশ হিসাবে হাজার হাজার তরুণ গুমের শিকার হয়েছেন বলে অভি্যোগ আছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো গোতাবায়াকেই হোয়াইট ভ্যান কার্যক্রমের স্থপতি বলে অভিহিত করে আসছে। সাংবাদিক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের অপহরণ, হত্যা ও হয়রানির ধারা বিদ্রোহ দমনের পরও বন্ধ হয় নি। সাংবাদিকদের সংগঠন আরএস এফ এর বৈশ্বিক গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে চলতি বছরে দেশটির অবস্থান ১৯ ধাপ নীচে নেমে ১৪৬-এ দাঁড়িয়েছে।
গোতাবায়ার অদূরদর্শী কর রেয়াতের ঘোষণা, রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে কৃষিকে জৈব সারমুখী করতে বাধ্য করা এবং উন্নয়ন পরিকল্পনায় বেসামাল ঋণ গ্রহণের জন্য যে দায়ী করা হচ্ছে, তা নিয়ে ভিন্নমতের কোনো অবকাশ নেই। শেষ পর্যন্ত ধার চাইতে তিনি বাংলাদেশেরো শরণাপন্ন হয়েছিলেন, এবং আমরা ঋণের কুড়ি কোটি ডলার কবে ফেরত পাবো, তা এখন কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। কিন্তু, আলোচনায় যে প্রশ্নটি উঠছে না, ত হলো সংখ্যালঘু তামিলদের দমনে সামরিক খাতে দেশটি যে বিপুল পরিমাণে ব্যয় করেছে, তা দেশটির অর্থনীতিতে কী প্রভাব ফেলেছিল?
বিদ্রোহ ও সহিংসতা দেশটির সেনাবাহিনীকেও বিপুলভাবে ক্ষমতায়িত করেছে। ক্ষমতায় থাকা রাজনীতিকদের সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক সামরিক আমলাদের বোঝাপড়া ও স্বার্থের যে সম্মিলন ঘটেছে, তার প্রমাণ হলো যুদ্ধাপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে চলা। সাবেক সেনাপ্রধান ও বর্তমান প্রতিরক্ষা প্রধানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। পদত্যাগের পর গোতাবায়া যেমন এখন রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন, এসব সেনা কর্তাদের ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম হওয়ার কথা নয়। পাশ্চাত্যের যেসব দেশ আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, সেসব দেশেও নির্বাসিত তামিল পরিবারগুলো যুদ্ধাপরাধের মামলা করার জন্য মুখিয়ে আছে। রাজনৈতিক শূণ্যতার সুযোগ গ্রহণে সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা না নিলেও রনিল বিক্রমাসিংহে ও রাজাপক্ষের দল দুটির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি তাদের সমর্থন অব্যাহত থাকাই স্বাভাবিক।
দেশটির আর্থিক সংকটের কারণে বছরখানেকের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। ফলে, বর্তমান পার্লামেন্ট ও তার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গণ-অভ্যূত্থানের পরিণতি কোন দিকে নিয়ে যাবে, তা বলা মুশকিল। আন্দোলনকারীদের তো রানিল বিক্রমাসিংহে `ফ্যাসিস্ট` বলে অভিহিত করেই ফেলেছেন। যেকোনো ধরণের স্থিতিশীলতায় অর্থনীতি হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে, কিন্তু জাতিতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের রাজনৈতিক সাফল্য মিলবে কী?
(২১ জুলাই, ২০২২-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন