‘এমন
নির্বাচন
কখনো
দেখেনি
কেউ’
শিরোনামে
ভোটের
এক
দিন
আগে
আমি
লিখেছিলাম,
দলীয়
সরকারের
অধীনে
গ্রহণযোগ্য,
সুষ্ঠু
ও
অবাধ
নির্বাচন
অসম্ভব
প্রমাণিত
হলে
বিরোধীরা
লাভবান
হবে,
তাদের
দাবির
যৌক্তিকতা
প্রমাণিত
হবে। ভোটের ফল ঘোষণার পর তারা সে কথাই বলেছে। পাঁচ বছর আগেও আমি লিখেছিলাম, ‘রাজনৈতিক
সরকার
যে
নিরপেক্ষ
নির্বাচন
আয়োজনে
অক্ষম,
সে
কথা
প্রতিষ্ঠার
জন্য
মন্ত্রীরা
যে
প্রাণান্তকর
চেষ্টা
চালিয়েছেন,
সে
জন্য
বিএনপির
উচিত
তাঁদেরকে
ধন্যবাদ
দেওয়া’
(যে
নির্বাচনে
দুই
পক্ষই
হেরেছে,
প্রথম
আলো,
৬
জানুয়ারি,
২০১৪)। তবে এবারে ধন্যবাদটা আরও বড় আকারে দেওয়া উচিত। কারণ, বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতার সংসদের চেয়েও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসন সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে তা বিশ্বাস করানো আগের চেয়েও কঠিন হয়ে পড়েছে।
ভোটের দিনে সহিংসতায় ১৭ জনের দুঃখজনক প্রাণহানি সত্ত্বেও নির্বাচন ছিল অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ। তবে আপাতদৃশ্যে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ কম নয়। ভোটের আগেই বাক্স ভর্তি, ভোটারদের ভোট দিতে না পারা ও ব্যালটে সিল মারার মতো অভিযোগ এসেছে। এগুলোর পাশাপাশি প্রদত্ত ভোট ও বিজয়ীদের প্রাপ্ত ভোটের যে উচ্চ হার দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে খুলনা, রাজশাহী ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী মডেলের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। অর্থাৎ, এবারের নির্বাচনে সিটি করপোরেশন মডেলের সফল জাতীয় রূপ দেখা গেল।
এবারের ভোটের ফলাফল এতটাই বিস্ময়কর যে নির্বাচন বিশ্লেষকেরা ভোটের শতাংশ বা সংখ্যাগুলো কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন, তা-ই বুঝে উঠতে পারছেন না। কয়েকজন প্রার্থী ভোট পেয়েছেন ৯৯ শতাংশ, যেমন বরিশাল-১ আসনে আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ। আরও এমন অনেক নেতা আছেন, যাঁরা ৯৯ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। ৯০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন শতাধিক প্রার্থী, যা স্বাভাবিক নয়। ফেনীর অঘোষিত রাজা বলে খ্যাত নিজাম হাজারী একটি (অক্সফোর্ড স্কুল) কেন্দ্রের ৩ হাজার ১৬৭টি ভোটের সব কটি ভোটই পেয়েছেন। মানবজমিন পত্রিকা জানিয়েছে, খুলনা-১ আসনে নৌকার প্রার্থী ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৬৯ এবং ধানের শীষের প্রার্থী ২৮ হাজার ১৭০ ভোট পেয়েছেন। অথচ এ আসনে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫৯ হাজার ৪২০। সেখানে মোট ভোটারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২২ হাজার ৪১৯ ভোট। এগুলো নিশ্চয়ই ‘গায়েবি’ ভোট!
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম এবং মাহবুব তালুকদার ভোট দিতে গিয়ে বিরোধীদের কোনো এজেন্টকে দেখতে পাননি। ভোট শুরুর প্রথম কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই অসংখ্য অভিযোগ পাওয়ার কথা বলেছেন মাহবুব তালুকদার। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এসব অভিযোগের জবাবে বলেছেন, কোনো প্রার্থী এজেন্ট না দিতে পারলে কমিশনের কী করার আছে। অথচ এক দিন আগে বিরোধীদের এজেন্টদের গ্রেপ্তার এবং ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগের পটভূমিতে তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি তাঁদের নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ভেতরেই তিনি এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে বাধা দেওয়া আর এজেন্ট দিতে না পারার ফারাকটা যেভাবে অস্বীকার করলেন, তা বিস্ময়কর। এই বিস্ময়ের কারণটাও সবার জানা। কেননা, ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কর্তা এইচ টি ইমাম থেকে শুরু করে অন্য নেতারা এমন ধারণাই তৈরির চেষ্টা করছিলেন যে বিরোধী জোট এতই দুর্বল যে তাদের এজেন্ট দেওয়ার মতো লোকও নেই। বাম জোট এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও তাঁদের এজেন্ট বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন।
সব ধরনের অনিয়মের সাক্ষ্য-প্রমাণ আড়াল করতে কমিশনের সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো কোনো এলাকার ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এজেন্টদের প্রতিবাদের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। বিষয়টি যে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ছিল না, বরং সারা দেশের ভোটচিত্রের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য, তার সাক্ষ্য একচেটিয়া ভোটের পরিসংখ্যান। দেশীয় সংবাদমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সারা দিনই তাদের বিশেষ আয়োজনে সরকার সমর্থক আলোচকদের নিয়ে সরকারি ভাষ্যকে ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরনের জল্পনায় সময় কাটিয়েছে। এদের মধ্যে অবশ্য দু-একটা চ্যানেল কিছুটা ব্যতিক্রম ছিল। ভোটের আগের অনিয়ম নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রচার করার পর যমুনা টিভির সম্প্রচার কেবল অপারেটরেরা আগের রাতেই বন্ধ করে দেয় বলে অভিযোগ আছে। ফলে অনলাইন ছাড়া তা দেখা যায়নি। তবে দেশীয় সংবাদমাধ্যমের চিত্র যা–ই হোক না কেন, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর ছবিটা ছিল উল্টো। বিবিসি, সিএনএন, আল–জাজিরা, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেনডেন্ট , ডয়েচে ভেলে, ওয়াশিংটন পোস্ট ও ইকোনমিস্টে ভোটের অনিয়মের ছবিগুলোকেই প্রাধান্য দিয়েছে। বিবিসি ভোট দিতে না পারা ভোটারদের সহায়তা করায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা, ভোট শুরুর আগেই ব্যালট বাক্স ভর্তি, ভোটকেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া পোস্টার-ফেস্টুন এবং কর্মীদের নিয়ন্ত্রণের ফুটেজকেই ব্রিটিশ দর্শকদের সামনে মুখ্য করে তুলে ধরেছে। এমনকি, অর্থনৈতিক পত্রিকা ফিন্যান্সিয়াল টাইমস–এর খবরেও ভোট জালিয়াতি, ভোট দিতে না পারা, বিরোধীদের এজেন্ট বিতাড়ন এবং ভোটের অবিশ্বাস্য ব্যবধানের বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে।
ক্ষমতাসীনেরা
ছাড়া
প্রায়
সব
রাজনৈতিক
দলই
এই
নির্বাচনে
অনিয়ম-কারচুপির
অভিযোগ
এনেছেন। বাম জোটের প্রধান শরিক সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম একে ‘ভুয়া
ভোটের
ভুয়া
নির্বাচন’
অভিহিত
করে
তা
প্রত্যাখ্যান
করেছেন। বাম জোট বলেছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে গোটা নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে সর্বাধিক আসনে এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দল ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনও এই নির্বাচনকে প্রহসন অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিদেশি সংবাদমাধ্যমে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিরোধীদের দাবির বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব পেয়েছে। তা ছাড়া অনিয়মের অভিযোগগুলো নির্বাচন কমিশন তদন্ত করে দেখছে বলেও এসব খবরে বলা হয়েছে। অভিযোগ তদন্তের বিষয়টিকে এসব সংবাদমাধ্যমে অনিয়মের প্রশ্নটিকে কমিশনের স্বীকৃতি হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে এই একচেটিয়া বিজয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। বিশেষত, ভোটের আগে বিরোধীদের ঢালাও গ্রেপ্তার, মামলা ও নিবর্তনের বিষয়গুলোতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগ-সমালোচনা কারও নজর এড়ায়নি। ফলাফল ঘোষণার পর হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক টুইটে ভোটের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে উদ্বেগের কথা প্রকাশ করা হয়েছে। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের গড়িমসিকে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হিসেবেই বিবেচনা করেছে।
প্রার্থী মনোনয়নে বিরোধী ঐক্যফ্রন্টকে যতটা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়েছে, তা কি এই বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে? সে ক্ষেত্রেও দেখা যায় যে এই বাধা সবচেয়ে বেশি এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে। উপজেলা বা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও পৌর মেয়রদের পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে সরকারের ভূমিকার কারণে তাদের অনেক প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে, অনেককে নানা গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা বিদ্রোহী প্রার্থীর সমস্যা ঐক্যফ্রন্টে যতটা না হয়েছে, তার চেয়ে ক্ষমতাসীন জোটে তা বরং অনেক বেশিই ছিল। আরও বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, কথিত মনোনয়ন–বাণিজ্যের কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ার কথা যেই দলটির, সেই জাতীয় পার্টিও বিস্ময়কর ফল করেছে। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর এবং সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদল নিয়ে কম কৌতুক হয়নি। দলটির প্রধান জেনারেল এরশাদ ও তাঁর স্ত্রী রওশন এরশাদ কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারেও অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায় না। এই পটভূমিতে তাঁদের দ্বিতীয় প্রধান দল হওয়াকে অলৌকিকই বলতে হবে।
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির রাজনৈতিক গাঁটছড়ার বিষয়টি ভোটের ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। ক্ষমতাসীন জোটের মনোনয়নে স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা বিকল্পধারার মহাসচিবের নির্বাচিত হওয়া সেই সংশয় জিইয়ে রাখছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই ফলাফল দেশের রাজনীতিতে কী পরিবর্তন আনবে? কার্যত ঐক্যফ্রন্টের সাতজন ছাড়া পুরো সংসদে বিরোধীপক্ষ বলে কেউ থাকার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচিতদের সংসদে থাকা বা শপথ নেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা শোনা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী আবারও জাতীয় পার্টিকে সরকার এবং বিরোধী দল উভয় আসনে বসাতে পারেন। সেটি হবে গত সংসদেরই পুনরাবৃত্তি। কার্যত এই সংসদকে একদলীয় সংসদ বললে তা খুব একটা ভুল হবে না। তবে গত সংসদে বিএনপি না থাকলেও রাজনীতিতে তারাই ছিল সরকারের প্রতিপক্ষ, এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটবে বলে মনে হয় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন