সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চমক সৃষ্টির চেষ্টাই উদ্বেগের কারণ!


মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের আগেই পুরো মন্ত্রীসভার নাম প্রকাশ এবং মন্ত্রীদের দায়িত্ব বন্টনের এক নতুন নজির তৈরি হয়েছে। এর আগে সাধারণত: শপথ নেওয়ার দিনেই মন্ত্রীরা ডাক পেতেন এবং শপথের আগে তা গোপন রাখা হোত। আর, মন্ত্রীদের দায়িত্ববন্টন শপথ গ্রহণের পর্ব শেষ হওয়ার আগে সম্ভবত কখনোই ঘটেনি।

এবারের নতুন মন্ত্রীসভার যেসব বিষয় মানুষের নজর কেড়েছে সেগুলোর মধ্যে প্রথম যেটি নজরে আসে তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রীসভায় প্রথমসারির রাজনীতিকদের কারোই ঠাঁই হয়নি। এমনকি, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক নতুন মন্ত্রীসভায় আগের দপ্তরের দায়িত্ব পেলেও তিনি অপেক্ষাকৃতভাবে রাজনীতিতে নবীন হওয়ায় অভিজ্ঞ নেতাদের সারিতে তাঁকে দাঁড় করানো সঙ্গত হবে না।

দ্বিতীয়ত, একটানা সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে দশ বছরে এবারই প্রথম আওয়ামী লীগের একক মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে। শরীক কেনো দলের ঠাঁই মেলেনি। স্মরণ করা যেতে পারে ১৯৯৬ সালে প্রথমবার সরকার গঠানের সময় প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী অন্য দুটি দলের নেতাদের মন্ত্রীসভায় স্থান দিয়েছিলেন। সবাইকে নিয়ে চলার নীতি থেকে স্পষ্টতই এটি একটি বিচ্যূতি।

তৃতীয়ত, এবারের মন্ত্রীসভার সংখ্যাগরিষ্ঠরা সব অর্থেই নতুন মুখ। রাজনীতিতেও তাঁদের অনেকের অভিজ্ঞতা যেমন বেশি দিনের নয়, তেমনই তাঁরা এবারই প্রথম মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছেন।

চতূর্থত, টেকনোক্র্যাট হিসাবে গত মন্ত্রীসভার দুজনের পুর্ননিয়োগ । এই দুজন কেন অপরিহার্য্য হয়ে উঠেছেন তা দলটির ভেতরেই অনেকের মনে প্রশ্নের জন্ম দেবে।

পঞ্চমত, নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন এমন মন্ত্রীদের বিদায়। তবে, নতুন মন্ত্রীসভায় স্থান পাওয়াদের মধ্যেও এর আগের মেয়াদে বিতর্কিত হয়ে বিদায় নেওয়া অন্তত তিনজনের প্রত্যাবর্ত্তন ঘটছে।


ষ্ষ্ঠত, মহাজোটের নতুন শরীকদেরও মন্ত্রীসভায় সুযোগ না পাওয়া। 

প্রশ্ন হচ্ছে নতুন মন্ত্রীসভার এসব বৈশিষ্ট্য থেকে রাজনীতির ভবিষ্যত গতি-প্রকৃতির কী আলামত মেলে ? যাঁরা এসব পরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন তাঁরা বলছেন প্রধানমন্ত্রী তরুণদের ওপর ভরসা রেখেছেন। তাঁদের বিশ্বাস এই তরুণরা হয়তো সরকারকে আরও উদ্যমী, প্রাণচঞ্চল ও কর্মঠ করে তুলতে পারবে। যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই নানা কারণে বিতর্কিত হয়েছেন। ফলে, আশাবাদীদের ধারণা দলের ইমেজ যতটা ক্ষুণ্ন হয়েছিলো তা পুনরুজ্জীবিত হবে।

যাঁরা এই নতুন চেহারার মন্ত্রীসভার বিষয়ে আশাবাদী নন, তাঁদের মূল আপত্তি হচ্ছে নির্বাচনকে ঘিরে। অনেকের কথায় রাতেরবেলার ভোটে যাঁরা সাংসদ হয়েছেন তাঁরা কীভাবে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনবেন।

নতুন মন্ত্রীসভার পক্ষে-বিপক্ষের এসব বক্তব্যের কোনোটিই হয়তো পুরোপুরি নাকচ করে দেওয়া যাবে না। তবে, এর বাইরেও কিছু গুরুতর প্রশ্ন থেকে যায়। জনআলোচনায় নির্বাচনের জালিয়াতি এবং অনিয়মের বিষয়টি যেভাবে প্রাধান্য পাচ্ছিলো তা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর চেষ্টা হিসাবে একটু চমক সৃষ্টির প্রয়াস হিসাবে এটিকে দেখা হলে তা কি অযৌক্তিক হবে? বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের মধ্যে যে অস্বস্তির জন্ম হয়েছে তা থেকে তাদেরকে মুক্ত করা যখন জরুরি তখন চমক সৃষ্টির বিকল্প কী ? তবে, মনে রাখা দরকার, বিদ্যূ্তের ঝলকে চমকিত হওয়ার সময় কখনো কখনো ঝলসে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।

নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলায় দলের জৈষ্ঠ্য রাজনীতিকরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সহায়ক ভূমিকা নাও নিতে পারেন এমন আশংকাও তাঁদের বাদ পড়ার কারণ হতে পারে। বিপরীতে, নির্বাচনে নিয়্ন্ত্রণ বজায় রাখায় তরুণরা তাঁদের আনুগত্য ও সামর্থ্যের প্রমাণ দেওয়ায় তাঁদের ওপরই এখন আস্থা বা ভরসা।

মহাজোটের পুরোনো এবং নতুন শরীকদের কাউকে মন্ত্রীসভায় স্থান না দেওয়ার কারণও হয়তো সেটাই। নির্বাচনকেন্দ্রিক সবধরণের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কাজে দলের তরুণ নেতাকর্মীরা যতটা দক্ষতা দেখিয়েছেন তাতে শরীকদের প্রয়োজনীয়তা ফুরোনোর প্রমাণ মিলেছে। মহাজোটের শরীক ডান-বামের ছোটো দলগুলোর বড় নেতাদের বাদ পড়ার কারণ সম্ভবত সেটাই। নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা এসব দল এখন ক্ষুব্ধ হলেও জোট ছাড়তে অক্ষম। সাংসদের সুযোগ-সুবিধাগুলো ত্যাগ করা তো আর সহজ কোনো কাজ নয়! একজন কবি প্রশ্ন রেখেছেন বাদ পড়া মন্ত্রীদের কেউ আত্মহত্যা করলে তার দায় নেবে কে ? আমার ধারণা সাংসদদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষমতার কারণে সেরকম ঝুঁকি আসলে শূণ্যের কোটায়।

আগের দুই মন্ত্রীসভাতেও মন্ত্রীরা যে ‍খুব স্বাধীনভাবে তাঁদের মন্ত্রণালয়ের নীতিগত বিষয়গুলো পরিচালনা করেছেন তা নয়। অপেক্ষাকৃত নবীন এবং অনভিজ্ঞ মন্ত্রীদের যোগ্যতার প্রশ্ন নিয়েও তাই তেমন দূর্ভাবনার কোনো কারণ নেই। বরং, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কার্য্যকর বিরোধীদলহীন একদলীয় সংসদে সরকারের জবাবদিহিতার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।   


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

ঘৃণা চাষের উর্বর ভূমি ও রাজনৈতিক সংকট

  দেশে একের পর এক অস্থিরতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এগুলোর কোনোটিই প্রত্যাশিত ছিল না। অনেকেই এগুলো নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুত সময়ে না হয়, তার জন্য পরিস্থিতি ঘোলাটে করার অপচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন। পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির পিছনে প্রধানত: দুটি শক্তিকে দায়ী করা হচ্ছে – একটি হচ্ছে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের পলাতক নেতৃত্বের সাংগঠনিক উদ্যোগ; অপরটি হচ্ছে, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম) সুবাদে সমাজে প্রভাব বিস্তারে দক্ষতা অর্জনকারী কিছু প্রভাবক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। এসব প্লাটফর্ম বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।  আপনি যদি কাউকে অপদস্থ বা হেয় করতে চান, তাহলে তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান সম্ভবত:  সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো একটি প্লাটফর্ম – বাংলাদেশে এটি ফেসবুক এবং ইউটিউব। বৈশ্বিক পরিসরে অবশ্য এক্স (সাবেক টুইটার) এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোয় এই সোশ্যাল মিডিয়া কী ভূমিকা রেখেছে, তা জাতিসংঘ তদন্...