মহাজোট সরকারে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রী ছিলেন এমন দুজন
নেতার দুটি সাক্ষাৎকারে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটের যে স্বীকারোক্তি
বেরিয়ে এসেছে অনেকেই হয়তো তাকে বঞ্চিতের হতাশার বহিপ্রকাশ হিসাবে নাকচ করে দিতে পারেন।
তাঁদের প্রতি করুণা বা সমবেদনা জানোনোর কিছু নেই। কিন্তু, তাঁদের স্বীকারোক্তিগুলোর
একটা ঐতিহাসিক মূল্য নিশ্চয়ই আছে।
সদ্য মন্ত্রিত্ব হারানো ওয়ার্কাস পার্টির প্রধান রাশেদ
খান মেনন বলেছেন ‘যারা অভিযোগ করছে,
তাদের একটি কথা বলতে চাই, ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়। তারা ২০০৬ সালে ইট মেরে ছিল, সেটা
কি ভুলে গেছে? কীভাবে আজিজ কমিশনকে দিয়ে ভুয়া ভোটার তালিকা তৈরি করেছিল ? এবার তার
একটা পাল্টা জবাব পেয়েছে‘। আসন্ন উপজেলা নির্বাচন কেমন হবে তার একটা ধারণাও তিনি দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন ‘আমরা আলাদাভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ
করবো। যদিও আমরা জানি, এই নির্বাচনে কী হবে! তারপরও আমরা নির্বাচন করবো‘। নির্বাচনে কলংক লাগলে সবার গায়ে লেগেছে মন্তব্যে স্পষ্টতই: জাতীয় নির্বাচনকে কলংকিত করার দায় অস্বীকার না করে
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও যে সাজানো এবং নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছেন।
নির্বাচনকে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রহসন
অভিহিত করা এবং ভোটের ফল কম লোকই বিশ্বাস করে বলে বিলাতের গার্ডিয়ান পত্রিকার মন্তব্যের
বিষয়ে বক্তব্য চাইলে আরেকজন সাবেক মন্ত্রী এবং নতুন বিরোধীদলীয় উপনেতা গোলাম
কাদের সেগুলো নাকচ করেন নি । তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন ‘আমি আমার এলাকায় পরিশ্রম করেই নির্বাচন করেছি। সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টগুলো
দেখছি। তবে সরকারের পক্ষে যেটা প্লাস পয়েন্ট সেটা হলো চীন, ভারত ও রাশিয়ার মতো বৃহৎ
শক্তিগুলোর স্বীকৃতি। এসবের কারণে যতটুকু যা–ই থাকুক, এর কোনো ‘অ্যাডভারস এফেক্ট’ আমার চোখে পড়ছে না‘। স্মরণ করা
যেতে পারে যে ২০১৪‘র বিনা প্রতিদ্বন্দিতার নির্বাচনকেও ওই তিনটি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। ইউরোপ
এবং আমেরিকার দেশগুলো যেমন স্বীকৃতি দেয়নি, তেমনি তাদের চাপের কারণে ২০১৮তে নির্বাচনে
সব দলের অংশগ্রহণের বিষয়টিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বর্পূণ হয়ে উঠেছিল। সংসদে তাঁর জাতীয়
পার্টি বিরোধীদলের আসনে বসলেও এবং বিএনপির সংসদে যোগদানের বিষয়ে অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও
সাক্ষাৎকারে গোলাম কাদের স্বীকার করে নিয়েছেন
যে বিএনপিই প্রকৃত বিরোধীদল।
একাদশ সংসদের যাত্রা শুরুর দিনে ব্রিটেনের প্রভাবশালী
সাময়িকী ইকোনমিস্ট সংসদকে ‘স্বচ্ছ জালিয়াতির নির্বাচনের‘ (Transparently fraudulant election) মাধ্যমে গঠিত বলে অভিহিত করেছে। পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়ার নানাপর্যায়ে ভিন্নমত
প্রকাশকারী একজন নির্বাচন কমিশনার, মাহবুব তালুকদারও প্রায় একই সময়ে আবারও বলেছেন যে
‘নির্বাচনে গ্রহণযোগ্যতা
ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে - এমন কোনো কথা নেই। জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে ‘।
সংবাদমাধ্যমে এসব বক্তব্য পড়ার পর স্বভাবতই প্রশ্ন
উঠতে পারে এসব বক্তব্যে সরকারের কিছুই আসে যায় না। কথাটা সত্যি। তবে, মহাজোটের ভেতরে ছোট শরীকরা যে করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন তার স্বীকারোক্তিও রাশেদ খান মেননের সাক্ষাৎকারে রয়েছে।
তিনি বলছেন ‘প্রথম থেকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ সঠিকভাবে জোট চর্চা করেনি বা করতে
চায়নি। আমরা যেটা বারবার গত ১০ বছরে জোর দিয়ে বলেছি, আপনারা জোট চর্চা করুন। এই জোট
চর্চার অপব্যবহারের কারণে একটি কেন্দ্রীভূত জায়গায় এসেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
কাছেই সমস্ত ক্ষমতা। শুধু আমরা নই, আওয়ামী লীগের লোকজনও জানে না, কেন তাদের মন্ত্রিত্ব
নেই? আমরা তো জানি না, কেন আমাদের মন্ত্রিত্ব নেই ? আওয়ামী লীগের একজন সিনিয়র নেতাকে
জিজ্ঞাসা করলাম ‘চিফ
হুইপ’ কে হচ্ছে ? বললো,
ভাই, জানি না। সুতরাং এটা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দেশে রাজনীতির পরিণতি, যেখানে ক্ষমতা
ক্রমান্বয়ে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে‘।
ক্ষমতার এই কেন্দ্রীকরণে গত ১০ বছর ধরে তিনি এবং বাম-ডান নির্বিশেষে তাঁর
সহযোগীরা পাল্লা দিয়ে সহযোগিতা করে এসেছেন তার দায়ভার তো তাঁদেরকেই নিতে হবে। এখন তো
আর তাঁর হতাশামুক্ত নতুন জীবন সূচনার অবকাশ নেই। বরং, করুণানির্ভরতাই ভরসা!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন