এবারের নির্বাচন বাংলাদেশে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতি কেন প্রয়োজন তা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছে। দেশে ব্যাঙ্গের ছাতার মত অসংখ্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক এবং বলতে গেলে অপরিহার্য্য। মুক্তিযুদ্ধ কিম্বা প্রাক-গণতন্ত্র যুগে আমাদের ভরসা ছিল বিবিসি এবং অন্য আরও কিছু বিদেশি সংবাদমাধ্যম। কিন্তু, গত ২৮ বছরের গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের অভূতর্পূব বিকাশেও সেই নির্ভরশীলতা কাটেনি। এজন্যে অনেকের মধ্যেই হতাশা ও দু:খবোধ আছে, কিন্তু, দৈন্য কাটানোর চেষ্টা আছে কি?
নির্বাচনটা কেমন হোল তার আসল চিত্রটা তুলে ধরতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর করুণ এবং হতাশাজনক ব্যর্থতা প্রকটভাবে ধরিয়ে দিয়েছে দুটো মাধ্যম। ১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সোশাল মিডিয়ার প্লাটফর্মগুলো – যেমন ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটার। ২. বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো। অবশ্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো ছিল ব্যাতিক্রম। বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর সঙ্গে, কিছু ব্যাতিক্রম ছাড়া, ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের নির্বাচনী সংবাদগুলোও আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। বিবিসি, আল জাজিরা, সিএনএন, ডয়েচে ভেলে, গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট এর বিবরণগুলোর বিপরীতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা রীতিমতো হতাশাজনক। ব্যাতিক্রম হিসাবে দু-একটি পত্রিকা কিছুটা চেষ্টা করেছে।
আবার বিদেশি গণমাধ্যমগুলোও তাদের ভিডিওচিত্রগুলোর জ্যামিতিক প্রসারে সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমকে ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছে। মোবাইল নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়ে বা তার গতি কয়ে দিয়ে আইন-শৃংখলাবাহিনী নিশ্চয়িই লাভবান হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের যাঁরা অন্যায় সুবিধা নিতে চেয়েছেন তাঁরাও লাভবান হয়েছেন। বিরোধীরা তাৎক্ষণিকভাবে ভোটকেন্দ্রগুলোতে লোকজনকে জড়ো করার সুযোগ পান নি , উত্তেজনা তৈরি করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তবে, তাতে করে ভিডিওধারণ বন্ধ থাকে নি এবং সময়সুযোগ পেলেই লোকজন সেগুলো সোশাল মিডিয়ায় তুলে দিয়েছেন। সেগুলোই আবার বিদেশি সংবাদমাধ্যম যাচাইবাছাই করে প্রকাশ করেছে। তাছাড়া, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের অনেকেই সাতসকালে ভোটকেন্দ্রে হাজির হয়ে ভোট শুরু হওয়ার আগেই ব্যালটভরা বাক্সের ভিডিও করতে পেরেছেন। ভোটকেন্দ্র ঘুরে ঘুরে ভোট দিতে না পারা ক্ষুব্ধ ভোটারদের যে প্রতিক্রিয়া দেখেছেন তার চমৎকার বিবরণ তুলে এনেছেন হয় ভিডিওতে, নয়তো বর্ণনায়। বিবিসি এবং ডয়েচে ভেলের অসংখ্য ভিডিও ক্লিপ দেশের ভিতরে তো বটেই বিশ্বেরও নানাপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
ভরদুপুরে ভোটকেন্দ্রের দরোজা বন্ধ করে রাখা, সেখান থেকে দলবদ্ধ পান্ডাদের বেরিয়ে আসা, কেন্দ্রের চারিপাশে শুধু ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর পোস্টারের ছবি, অন্য দলের এজেন্ট না থাকা, সাংবাদিকদের সঙ্গে ভোটারদের কথা বলতে না চাওয়ার যে ভীতিকর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি এগুলোর সবই বিশদভাবে উঠে এসেছে এসব বিদেশির খবরে। তারা ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর ভিডিও এবং খবরগুলোর কথাও উল্লেখ করেছে। কিন্তু, বিপরীতে আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সময় কাটিয়েছে স্টুডিওতে মুখচেনা আলোচকদের আলোচনায়, যাঁদের প্রধান কাজ ছিল বিরোধীদলের সমালোচনা। এজেন্টদের ভয় দেখিয়ে বাধা দেওয়া আর এজেন্ট দিতে না পারার ফারাকটা তাঁরা ক্রমাগত অস্বীকার করে গেলেন। এটি যে দলমতনির্বিশেষে সরকারবিরোধী সবার ক্ষেত্রে হয়েছে সেই তথ্যটুকুও তাঁরা উল্লেখ করতে পারেন নি। বিরোধীরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন দেখার পরও বলা হয়েছে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর, ক্ষমতাসীন দলের ভাষ্য পেলে তাকেই সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়েছে। ফলে, যত সহিংসতা হয়েছে তার সবটার দায় চাপানো হয়েছে বিরোধীদের ওপর। কিন্তু, তার উল্টোদিকটা অনুচ্চারিতই থেকে গেছে।
আমাদের গণমাধ্যম যে গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না তা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিলো । নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দী দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা যেমন ছিল না তেমনই ছিল দৃষ্টিকটু পক্ষপাত। নির্বাচনের পর তা আরও প্রকট হচ্ছে। ফেসবুকের মত মুক্ত প্লাটফর্মে আমাদের আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার যেসব ছবি দেখা যায়, টেলিভিশনের পর্দা কিম্বা কাগজের পাতায় তা দেখা যায় না। সেখানে আসে খন্ডিত সত্য, তথ্যবিকৃতি, বিশেষ মোড়কে উপস্থাপিত বয়ান বা ভাষ্য। এসব বিবরণে অত্যাবশকীয় সব প্রশ্নের উত্তর মেলে না, বরং থাকে অবিশ্বাস্য নানা ব্যাখ্যা যাতে রাজনৈতিক বা বাণিজ্যিক স্বার্থের নগ্নছাপ ধরা পড়ে। বিরোধী রাজনীতিক ও ভিন্নমত পোষণকারী নাগরিকদের টেলিফোনের কথাবার্তা গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার সাম্প্রতিকবছরগুলোতে একটি নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সেগুলোর যথার্থতা যাচাই ও সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ প্রদান ছাড়াই সূত্রহীন এসব অডিও থেকে খবর তৈরি হয়েছে। অথচ, ক্রসফায়ার এবং গুমের শিকার পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে এসব অপরাধে জড়িতদের কথোপথনের রেকর্ডিং প্রকাশ করা হলেও গণমাধ্যম তা প্রচার থেকে বিরত থাকে। রাজনৈতিক কারণে অপছন্দের ব্যাক্তিকে গণমাধ্যমে অপদস্থ করার মত অনৈতিক কাজেও কেউ কেউ পিছপা হন না। দর্শক-শ্রোতা-পাঠকের প্রত্যাশায় এসব প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকদের তাতে কিছুই আসে যায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন এমনটি ঘটছে ? এর একটি কারণ অবশ্যই সাংবাদিকদের একটি বড় অংশের দলীয় আনুগত্য। সাংবাদিকতা পেশার নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার বিপরীতে তাঁরা ব্যাক্তিগত রাজনৈতিক বিশ্বাস, দলীয় আনুগত্য বা বিশেষ বিশেষ রাজনীতিকের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নগুলোকে প্রাধান্য দেন বা দিতে বাধ্য হন। আর, দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক। গত দুই দশকে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিকের আনুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত। অনেকগুলোরই মালিক সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা তার খবরের ভোক্তার কাছে নয়, বরং রাজনৈতিক এবং আর্থিক ক্ষমতার অধিকারী যাঁরা, সে সব পৃষ্ঠপোষকের কাছে। এবারের নির্বাচনে দুটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর মালিকানাধীন দুটি টিভি চ্যানেল এবং দুটো পত্রিকায় তার নগ্ন প্রতিফলন দেখা গেছে। উভয় প্রতিষ্ঠানের মালিক বা মালিকানার অংশীদার একই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় এই চিত্রটি এতোটা খোলাসা হয়ে পড়ে।
তৃতীয় কারণটি সবার জানা। তবে, তা নিয়ে খুব একটা আলোচনা নেই। নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা যে জনমনে সমালোচিত তা বিদেশিদের চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে। মানবাধিকার ও সাংবাদিকদের সুরক্ষাবিষয়ক সংগঠনগুলোর বক্তব্যে তা প্রতিফলিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আলাদা করে প্রতিবেদন করেছেন ভয়েস অব আমেরিকার সাংবাদিক মাজ হোসেন । তিনি এর কারণ হিসাবে লিখেছেন যে নানাধরণের ভীতি ও চাপের কারণেই এমনটি ঘটছে। এবিষয়ে প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরীর একটা বক্তব্যও রয়েছে (অপজিশন অ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি অ্যাকটিভিস্টস ক্রিটিসাইজ ইলেকশন কাভারেজ ইন বাংলাদেশ, ১৩ জানুয়ারি, ভোয়া.কম)। তিনি বলেছেন ‘বাংলাদেশের সাংবাদিকরা একধরণের হুমকি বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে কাজ করছেন এভাবে সাধারণীকরণ করা হলে সেই মন্তব্য ঠিক হবে না। কেননা, এটা হয়তো হয়েছে এক, দুই, তিন কিম্বা চারজনের ক্ষেত্রে। তিনি আরও বলেছেন কোনো সাংবাদিক কোনো গোয়েন্দা সংস্থা থেকে হুমকি পেয়ে থাকলে তার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানানো উচিত। সম্পাদক পরিষদ, প্রেস ইনিস্টিটিউট এবং প্রেস কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠান আছে তারা কেউ এধরণের অভিযোগ পেয়েছেন বলে আমার মনে হয় না। তারা এধরণের নিরাপত্তা সংস্থার বিরুদ্ধে আদালতেও যেতে পারে। সম্ভবত এটিই প্রথম একটি স্বীকারোক্তি যে অল্প কয়েকজন সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। দেশের নব্বুই শতাংশ গণমাধ্যম যেখানে সরকারবান্ধব সেখানে সবার ওপর এধরণের হুমকির কোনো প্রয়োজন হওয়ার কথাও নয়।
বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ব্যুরো দিল্লিতে হওয়ায় এই অঞ্চলের খবরগুলোর ক্ষেত্রে ভারতীয় সাংবাদিকদের সাধারণভাবে একটা ভূমিকা থাকে। বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। সেকারণে, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে তারা যে সবসময়ে বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছে তা নয়। তবে, ভারতীয় পত্র-পত্রিকা রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনোধরণের কার্পণ্য করে নি।
বাংলাদেশে অভূতর্পূবরুপে বিকাশ লাভ করা গণমাধ্যমের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একটা বড় পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় নিজেদের অবস্থান পাঠক-দর্শক-শ্রোতার কাছে কতোটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে সেই আত্মজিজ্ঞাসা অতীব জরুরি। কেননা, সাধারণ মানুষ যদি আবারও বিদেশি গণমাধ্যম এবং সোশাল মিডিয়াকেই শেষ ভরসা মানে তাহলে শুধু গণমাধ্যমই যে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, সাংবাদিকতা পেশাও বড়ধরণের সংকটের মুখে পড়বে।
(২২ জানুয়ারি, ২০১৯‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন