সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মন্ত্রী ও সাংসদদের ব্যবসার নৈতিকতা

জাতীয় নির্বাচনের প্রার্থীদের হলফনামা নিয়ে সংবাদপত্রে বেরোনো প্রতিবেদনের হিসাব রাখা প্রায় অসম্ভব। হলফনামার যথার্থতা ও সম্পদের বিবরণ ঘিরে বিস্ময় ও বিতর্ক চলছেই। আমাদের কপাল ভালো, নির্বাচন কমিশন নানা বিষয়ে সরকারের চাপ ঠেকাতে সক্ষম না হলেও এই একটি বিষয়ে সরকারের শক্তিশালী অংশীদার জাসদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করেনি। আজ থেকে ঠিক ১৪ মাস আগে ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর এক সংলাপে জাসদের প্রধান তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু হলফনামার বিধান বাতিলের দাবি জানিয়েছিলেন (‘বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন চায় জাসদ’, যুগান্তর, ৯ অক্টোবর ২০১৭)। তবে তাঁর দাবিগুলোর মধ্যে নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধের কথাও ছিল।
জাসদের এই দাবিটি স্মরণ করার উদ্দেশ্য এই নয় যে ২০১৩ ও ২০১৮ সালের হলফনামা দুটো মিলিয়ে পত্রিকাগুলো হিসাব দেখিয়েছে যে ৫ বছরে দলটির সভাপতির হাতে নগদ টাকা বেড়েছে ৭ গুণ এবং তাঁর স্ত্রীর ৬০ গুণ। বরং ওই দাবি নাকচ হয়ে যাওয়ার কারণেই আমরা জানতে পারছি, দলমত–নির্বিশেষে রাজনীতিকদের আর্থিক সমৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল। যতই বলা হোক না কেন, বিরোধীরা সরকারের তাড়ার ওপরে রয়েছেন, তাঁদের কারও কারও আয় বৃদ্ধির হারে সে রকম প্রতিকূলতার ছাপ মেলে না। স্বভাবতই ক্ষমতাসীনদের সমৃদ্ধি ক্ষমতায় না থাকা নেতাদের চেয়ে বেশি চোখে পড়েছে।
উন্নয়নের ধারায় দ্রুত অগ্রযাত্রার কারণে আমরা যখন নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছি, তখন তার সঙ্গে রাজনীতিকদের সমৃদ্ধির হারের সামঞ্জস্য থাকা স্বাভাবিক, এমন যুক্তি নাকচ করা সহজ নয়। কেননা, গত ১০ বছরে আমাদের মাথাপ্রতি আয় বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। তবে দুঃখজনকভাবে এটি আয়বৈষম্য বাড়ার—অর্থাৎ অতি দ্রুত ধনীর আরও ধনবান এবং গরিবের আরও গরিব হওয়ার নজির বলে দাবি করাও সম্ভব।
জনপ্রতিনিধিদের আয়-রোজগার বাড়ায় কারোরই আপত্তি থাকার কথা নয়, যদি তা হয় সৎ উপার্জন এবং তাতে স্বচ্ছতা থাকে। সংসদে মন্ত্রী-সাংসদদের বেতন-ভাতার এই বৃদ্ধিতে কোথাও কোনো প্রতিবাদের খবর চোখে পড়েনি। তাঁদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির হার অন্যদের তুলনায় কম নয়। অনেকের তা ঈর্ষারও কারণ হতে পারে। বিশেষ করে সাংসদদের নিজের পছন্দ অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্পে খরচের জন্য বার্ষিক ৪ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ থাকে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও তা পান না।
কিন্তু এত সব আর্থিক সুযোগ-সুবিধার পরও দেখা যাচ্ছে সাংসদ ও মন্ত্রীদের নানা ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিয়মিত আয় আসছে। কারও কারও ক্ষেত্রে এ আয় কয়েক কোটিরও বেশি। আবার এত দিন যে ‘সুনাম’ সরকারি চাকুরেদের জন্য সংরক্ষিত ছিল, সেটিও এখন তাঁদের অনেকের বেলায় দেখা যাচ্ছে—তাঁদের সম্পদের সিংহভাগ স্ত্রীদের নামে। ২০০৮ থেকে ২০১৩ মেয়াদে মন্ত্রী-সাংসদদের অনেকেরই পছন্দের ব্যবসা ছিল মাছ চাষ। গত মেয়াদে তা হয়েছে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ। পাশাপাশি অন্য ব্যবসাও রয়েছে। রয়েছে বিচিত্র বন্ড ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এবং সেগুলো থেকে নিয়মিত আয়। এমনকি মন্ত্রিত্বের পাশাপাশি কেউ কেউ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন (যেমন ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া)। আইনমন্ত্রী মন্ত্রিত্বের পাশাপাশি শুধু যে আইন পেশা চালিয়ে যাচ্ছেন তা-ই নয়, এ থেকে তাঁর বার্ষিক আয় ৬ কোটি থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি টাকা। অবশ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপালনের পাশাপাশি এমন অসাধ্য সাধন কীভাবে সম্ভব, তা আমাদের বোধগম্য নয়।
অধিকাংশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মন্ত্রীদের মন্ত্রিত্ব গ্রহণের আগেই ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে ছুটি নিতে হয়, সাংসদেরা দ্বিতীয় কোনো চাকরি বা পেশা গ্রহণ করতে পারেন না, খণ্ডকালীন হিসেবেও নয়। কেননা, জনপ্রতিনিধির কাজটা খণ্ডকালীন নয়। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের বেতন-ভাতা নিয়ে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজ ওই সব দেশে নৈতিকতার পরিপন্থী বলে বিবেচিত হয়। বক্তৃতা দিয়ে ফি গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও বছরের জন্য একটা সীমা নির্ধারণ করা আছে এবং তা প্রকাশে তাঁরা বাধ্য। এসব ক্ষেত্রে তাঁদের সব বিনিয়োগ ব্লাইন্ড ট্রাস্ট নামে পরিচিত ট্রাস্ট গঠন করে সেখানে তা হস্তান্তর করতে হয় এবং এসব ব্যবসার সঙ্গে তাঁরা কোনো যোগাযোগ রাখতে পারেন না। মন্ত্রিত্বের মেয়াদে সেসব বিনিয়োগের লাভ-ক্ষতির খবর নেওয়ারও সুযোগ থাকে না।
বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো মিনিস্ট্রিয়াল কোড বা মন্ত্রীদের আচরণবিধি আছে কি না, তেমন কোনো তথ্য সরকারি কোনো প্রকাশনায় পাওয়া যায়নি। এমন আচরণবিধি থাকলে কোনো মন্ত্রীর পক্ষেই এ ধরনের আয়-রোজগারের পথ খোলা থাকার কথা নয়। আর যদি থেকেই থাকে, তাহলে সে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিকার নেই কেন?
সরকারের বড় আকারের বিভিন্ন কেনাকাটা বা প্রকল্প বাছাইয়ের জন্য মন্ত্রিসভার বিভিন্ন ধরনের কমিটি হয়। ধরা যাক, এ রকম একটি কমিটিতে পরের সপ্তাহে এমন একটি কোম্পানির সঙ্গে একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি সইয়ের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যা শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত। চুক্তি সইয়ের খবর আগাম জানার কারণে মন্ত্রী যদি সে কোম্পানির শেয়ারে আগাম বিনিয়োগ করেন, তাহলে যে অর্থনৈতিক অপরাধ সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা ঘটে, তার প্রতিকার কী? এ রকম কোনো অপরাধ ঘটেছে কি না, তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু সেটা অসম্ভব কিছু নয়।
মাছ চাষের আয় যখন করমুক্ত ছিল, তখন মন্ত্রী-সাংসদেরা পুরোদমে তার সুযোগ নিয়েছেন; কিন্তু তাঁরাই তার ওপর কর বাড়িয়ে ওই শিল্পের স্বার্থের কথা আর ভাবেননি। সেখান থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়ে বিনিয়োগ করেছেন শেয়ারে। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য ডিভিডেন্ডের ওপর কর রেয়াতসহ সরকারের তরফে যেসব প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিনিয়োগ যদি সেসব সুযোগ গ্রহণের জন্য সেখানে গিয়ে থাকে, তাহলে কি নৈতিকতার প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয়?
বিভিন্ন সঞ্চয়পত্র ও বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন উঠবে। কেননা, বাংলাদেশে বেসরকারি বন্ডের বাজার নেই। সরকারি বন্ডের সুদের হার বাড়ানো-কমানোর মূল ক্ষমতা অর্থ মন্ত্রণালয়ের। সে ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনার আশঙ্কা থেকেই যায়। স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিয়ে আমাদের সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। তাই বলে নৈতিক বোধও যে নেই, সেটাই দুঃখজনক।
(১০ ডিসেম্বর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...