সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

নির্বাচনে সরকার কী আড়াল করতে চায়

এনফ্রেলের পর্যবেক্ষকদের ভিসা প্রদানে গড়িমসির কারণে হতাশা প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণে কাউকে না পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর বিদেশিদের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিষয়টিতে সরকারের মনোভাব অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। ৩২ জনের ভিসার অনুরোধে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে মাত্র ৬ জনের অনুমতি দেওয়াকে যদি কোনো দেশ গড়িমসি মনে করে, তাহলে তা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়? নির্বাচনে বিদেশিদের নজরদারিতে সরকার অনাগ্রহী। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অনাগ্রহের কারণ কী?
এর আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নও প্রস্তুতির জন্য যথেষ্ট সময় না থাকায় পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। তা ছাড়া, নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণে অনিশ্চয়তার কারণেও তারা নিজ উদ্যোগে আগে থেকে এ বিষয়ে প্রস্তুতি নেয়নি। বাকি ছিল কমনওয়েলথ।
গত সপ্তাহে কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড লন্ডনে এক অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় দেরিতে অনুরোধ আসার কারণে প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ের অভাবে এবার বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না, মন্তব্য করেছেন বলে ওই আলোচনায় উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে।
 সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে যে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে দেশি-বিদেশি সবার জন্য সুযোগ উন্মুক্ত থাকবে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রদূতদের কাছে প্রধানমন্ত্রীও পর্যবেক্ষক পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছেন বলে তাঁর দপ্তরকে উদ্ধৃত করে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তবে, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম একাধিকবার স্থানীয় ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে নানা রকম নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন।
যেকোনো দেশের নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ বা বিদেশি পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণের বিষয়টি যেসব বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, তার মধ্যে এক নম্বর এবং অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হচ্ছে স্বাগতিক দেশের আমন্ত্রণ। এখন আপনি যদি এমন সময় বেছে নিয়ে আমন্ত্রণ জানান যে তখন আর আমন্ত্রিতদের সে অনুরোধ রক্ষার প্রস্তুতির সময় থাকবে না, তাহলে তো আপনার আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে সেটাই তো স্বাভাবিক। আরও হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের প্রধান উৎসব বড়দিন এবং নববর্ষের সপ্তাহে।
 দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষণে জাতিসংঘ ঘোষিত একটি নীতিমালা আছে। ডিকলারেশন অব প্রিন্সিপালস ফর ইন্টারন্যাশনাল ইলেকশন অবজারভেশন অ্যান্ড কোড অব কনডাক্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ইলেকশন অবজারভারস নামের এই নীতিমালায় অন্তত ডজনখানেক শর্ত আছে, যেগুলো পূরণে স্বাগতিক দেশ রাজি না হলে কোনো বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা পর্যবেক্ষণে যান না। এসব শর্তের মধ্যে তাঁদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ওই নীতিমালায় স্পষ্টতই বলা আছে, কোনো অগণতান্ত্রিক নির্বাচনীপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দেওয়ার ধারণা তৈরি করতে পারে, এমন কোনো পর্যবেক্ষণ মিশনে কোনো সংস্থারই অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। পর্যবেক্ষকদের মূর্তির মতো ভূমিকা পালন করার নির্দেশনার কথা চাউর হওয়ার পর বিদেশিদের এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি বুঝে নেওয়ারই কথা।
 তৃতীয়ত, নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শুধু ভোটের দিনের বিষয় নয়। নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ, নির্বাচনের প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে সবার অবাধে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ, সরকার বা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বাধা সৃষ্টি বা হস্তক্ষেপমুক্ত প্রচার, সভা-সমাবেশ আয়োজনের ক্ষেত্রে সবার সমসুযোগ, ভোটের অধিকার, গণমাধ্যমের ভূমিকা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণও পর্যবেক্ষকদের দায়িত্বের অংশ। সেই সুযোগ না রাখায় তাঁরা নিরুৎসাহিত হতেই পারেন। কমিশন অথবা সরকার যদি প্রাক্‌-নির্বাচনী সহিংসতা অথবা অন্যায় এবং একচেটিয়া প্রচারসুবিধা গ্রহণের বিষয়গুলো কারও দৃষ্টি থেকে আড়াল করতে চেয়ে থাকে, সে চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের বিবৃতি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন তার সাক্ষ্য দেয়। এখন ভোটের দিন শান্তিপূর্ণ হলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অনুপস্থিতির অভিযোগ থেকে আর রেহাই মিলবে না।
 আন্তর্জাতিক পরিসরে নিয়মিত নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিষ্ঠান, সেই ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) গত ১২ অক্টোবর প্রকাশিত তাদের প্রাক্‌-নির্বাচন মূল্যায়নে বলেছিল, কমিশনের অনেক বিধান পর্যবেক্ষকের অধিকারের ওপর অন্যায় নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক রীতিনীতির পরিপন্থী। তারা সেসব বিধিনিষেধ অপসারণের আহ্বান জানালেও সেগুলো মানা হয়নি।
 এখন জানা যাচ্ছে, স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের অংশগ্রহণও সীমিত করার নানা কৌশল সরকার ইতিমধ্যেই কার্যকর করেছে। প্রথমত, বেশ কয়েকটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের অযৌক্তিক আপত্তির কারণে তারা পর্যবেক্ষণের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে বা যাদের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিষয়ে সরকারের মনে সন্দেহ আছে, তাদের বিদেশি তহবিল ছাড় করার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করে কাজ করতে না দেওয়া। যে কারণে এবার ৩৫ হাজারের মতো দেশীয় পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন বলে শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত ছাড় পেয়েছেন ২৬ হাজারের মতো। কমিশনের হিসাব অনুযায়ী এবারে পর্যবেক্ষকের সংখ্যা ২০০৮ সালের ছয় ভাগের একভাগ। সারা দেশে যে ৪০ হাজার ভোটকেন্দ্রে ভোট নেওয়া হবে দেশীয় পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা তার চেয়েও কম। এর ফলে অন্তত ১৫ হাজার কেন্দ্রে ভোট গণনার সময় কোনো পর্যবেক্ষক থাকবে না।
এনডিআই অক্টোবর মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে তাদের কাছে উদ্বেগ জানানো হয়েছে যে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পর্যবেক্ষকদের তালিকা চেয়েছে এবং পর্যবেক্ষকেরা আইনপ্রয়োগকারী ব্যক্তিদের কাছ থেকে টেলিফোনে হুমকি পেয়েছেন। নির্বাচন কর্মকর্তাদের মতো তালিকা ধরে দেশীয় পর্যবেক্ষকদের বিষয়ে পুলিশের অনুসন্ধান চালানো মোটেও স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়।
বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা এবং স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের অনুমোদনপ্রক্রিয়ায় সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক প্রভাব বিস্তারে স্পষ্টতই আলামত মেলে যে ক্ষমতাসীন সরকার নির্বাচনকে স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও অবাধ করার বিষয়ে আগ্রহী তো নয়ই, বরং তাকে নিরুৎসাহিত বা বাধাগ্রস্ত করছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো যেসব অভিযোগ ও আশঙ্কার কথা এত দিন ধরে জানিয়ে আসছে, সরকারের এসব অদূরদর্শী পদক্ষেপ সেগুলোকেই প্রতিষ্ঠা করছে। তা না হলে, সরকার কী আড়াল করতে চায়—সেই প্রশ্নের অন্য কোনো জবাব তো নেই। 
(২৪ ডিসেম্বর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধ।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...