প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার আশা পূরণ হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তিনি নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হবে, সে আশা আমাদের পূরণ হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সে পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’ শুধু একটু প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই যদি কমিশনের আশা পূরণ হয়ে যায়, তাহলে একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান আদৌ তাদের লক্ষ্য কি না—সেই প্রশ্নটি উঠে আসে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনটা যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রহসন না হয়। সিটি করপোরেশনগুলোর মতো অংশগ্রহণমূলক অথচ বিরোধীদের ধরপাকড়, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্সভর্তির মডেলই হয়তো তাদের আরাধ্য। ভোটাররা কী চান কিংবা সংবিধান তাদের কী দায়িত্ব দিয়েছে, সেগুলো তাদের বিবেচ্য নয়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই একই অনুষ্ঠানে বলেছেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ে তাঁরা আচরণবিধি লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা দেখেননি। আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যক্তিগতভাবে তাঁর চোখে পড়ার কথাও নয়। কেননা, তাঁর কার্যালয়ে কেউ মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাননি। হতে পারে যেসব জেলা প্রশাসক এবং অন্যান্য সরকারি আমলা এখন কমিশনের হয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন, তাঁরাও নানা কারণে চোখ বন্ধ করে আছেন অথবা কমিশনে ভুল তথ্য পাঠাচ্ছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে যেসব ছবি ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে যেসব ভিডিও প্রচারিত হয়েছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীরা যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলো যাচাই না করে নাকচ করার মাধ্যমে কমিশন যে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে, সেটি কি তারা উপলব্ধি করতে পারছে না? সিলেটে অর্থমন্ত্রীর ভাইয়ের মিছিল করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়া, দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ডেপুটি স্পিকারের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার ছবি, মাগুরায় ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে রিটার্নিং কর্মকর্তার দপ্তরে আপ্যায়নের ছবি, রাজশাহী ও বরিশালের প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শনের মতো ছবিগুলোর সত্যতা যাচাই করা তো দুঃসাধ্য কিছু নয়?
অবশ্য অন্যতম কমিশনার রফিকুল ইসলামের শুক্রবারের বক্তব্যকে যদি কমিশনের আসল অক্ষমতা বা সীমাবদ্ধতার ব্যাখ্যা বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতেই হবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আশা না করাই ভালো। তিনি বলেছেন, ‘আমরা সরকার নই, নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনকালীন হোক আর যেটা হোক, একটা সরকার আছে। সংবিধান অনুযায়ী সেই সরকারের কাছে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া আছে। তাদের দায়িত্ব তো আমাদের পালন করার কথা না।’ ওসি, ইউএনও এবং ডিসিদের পরিবর্তনের বিষয়ে বিরোধীদের দাবি সম্পর্কে তিনি যা বলেছেন, তার মানে দাঁড়ায়, এঁদের পরিবর্তন করতে যে বিশাল বাজেট লাগবে, সরকারের অন্যান্য কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে, সে রকম কিছু তাঁরা করতে পারেন না।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কথায় প্রথমত যেটি স্পষ্ট হয়েছে তা হলো, দলীয় সরকারের অধীনে কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে অক্ষম। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতায়িত হওয়ার পরও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে এ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা সীমিত। দ্বিতীয়ত, তারা প্রশাসনে রদবদলের চেষ্টা করতে গিয়ে অথবা করে ব্যর্থ হয়ে বুঝতে পেরেছে সরকার প্রশাসনিক প্রয়োজনের কারণ দেখিয়ে তাদের সে ধরনের উদ্যোগ হয় নাকচ করে দিয়েছে, নয়তো বাধা দিচ্ছে। তৃতীয়ত: কমিশনের ত্রিশঙ্কু অবস্থার একটা ধারণাও তাঁর
কথায় পাওয়া যায়। তিনি একই প্রশ্নের উত্তরে সাংবাদিকদের বলেছেন গণভবনে প্রচারণা চালালে
আচরণবিধি ভঙ্গ হবে, কিন্তু সামরিকবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সেখানে প্রধানমন্ত্রীর
সঙ্গে দেখা করায় আচরণবিধির লংঘন ঘটেনি। অথচ, সেই অনুষ্ঠানের খবরগেুলোতে যে সব রাজনৈতিক
বক্তব্য প্রচারিত হয়েছে সেগুলো স্পষ্টতই নির্বাচনী বক্তব্য ছিল, ক্ষমতাসীনদের প্রধান
প্রতিদ্বন্দীদের বক্তব্যের সমালোচনায় র্পূণ ছিল।
সমস্যা হচ্ছে নির্বাচনে প্রশাসনিক পক্ষপাত, ক্ষমতাসীনদের সরকারি সুবিধার অপব্যবহার এবং কমিশনের ব্যর্থতা বা অক্ষমতার বিষয়ে অভিযোগটা যে শুধু দেশের ভেতরেই উঠছে, তা নয়। বিদেশিরা বড় আকারে কোনো পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম না চালালেও এগুলোর কোনো কিছুই তাদের নজর এড়াচ্ছে না। ২০১৪ সালের বিনা ভোটের নির্বাচনের স্মৃতির তাড়নায় এই নির্বাচনে বিশ্বসম্প্রদায় যে ঠিকই দৃষ্টি রাখছে, তার সর্বসাম্প্রতিক নজির হচ্ছে ব্রিটিশ এমপিদের জন্য তৈরি হাউস অব কমন্সের লাইব্রেরির গবেষণাপত্রের মূল্যায়ন। এতে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি সবার সমান সুযোগ সৃষ্টি বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’-এর ধারেকাছেও নেই। একদিকে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিচ্ছে, অন্যদিকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন তীব্র রয়ে গেছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিয়মকানুনের প্রতি (রুলস অব গেম) সার্বিক আস্থার মাত্রা তলানিতে রয়ে গেছে। তারা অবশ্য এ কথাও বলতে ভোলেনি যে অধিকাংশ পণ্ডিতের ধারণা, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হবে।
আওয়ামী লীগ হয়তো এতে উৎসাহিত বা উৎফুল্ল বোধ করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার নির্বাচনকে ইতিমধ্যেই প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। কেননা, অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আর যা–ই বলা হোক, অন্তত ‘সুষ্ঠু নির্বাচন’ কেউ বলবে না।
এ রকম দিন সচরাচর আসে না, যখন একই দিনে বিশ্বের তিনটি শহরে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হয়। দিনটি ছিল ১৫ নভেম্বর। সেদিন স্ট্রাসবুর্গে ২৮টি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী ইউরোপীয় পার্লামেন্টের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের বিতর্কে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের এই নির্বাচনই গণতন্ত্রের জন্য শেষ সুযোগ। সেদিনই লন্ডনে রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স, যা চ্যাথাম হাউস নামে অধিক পরিচিত, সেখানে অনুষ্ঠিত আলোচনায় বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে একই ধরনের উদ্বেগের কথা শোনা গেছে। কূটনীতিক, গবেষক ও নীতিনির্ধারকদের ওই বৈঠকে নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। শঙ্কা হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হলে তার পরিণতি হবে বিরোধীদের নির্মূলকরণ এবং আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠার আশঙ্কা। আর বিরোধীরা জয়ী হলে তাদের প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠার আশঙ্কা। ওই একই দিনে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের টম লানটোস হিউম্যান রাইটস কমিশনের সভায় বাংলাদেশে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়। সেই সভায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিনিধির বক্তব্যের বিবরণ নিশ্চয় কেউ বিস্মৃত হননি।
এর আগেই যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেকটি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট তার প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে অন্তরায় হিসেবে ক্ষমতাসীন দলের বাড়তি সুবিধা নেওয়া এবং বিরোধীদের ওপর অব্যাহত দমন–পীড়নের অভিযোগগুলোর কথা বলেছিল। প্রাক্-নির্বাচন সংলাপের পটভূমিতে ধারণা করা হচ্ছিল পরিবেশ বদলাবে, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু ধরপাকড় যেমন থামেনি, তেমনি মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে গায়েবি মামলায় কারও কারও ঠাঁই হয়েছে কারাগারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। সুতরাং কমিশন যে চশমায় অনিয়ম, আচরণবিধি লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার দেখতে পায় না, সেই চশমাটা তাদের বদলানো প্রয়োজন এবং অচিরেই। কমিশন না দেখতে পেলেও বিশ্বের অন্য অনেকেই দেখছে।
(৩ ডিসেম্বর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় নিবন্ধটি সামান্য সংক্ষেপিত রুপে ছাপা হয়েছে।)
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
লেবেল
নির্বাচন কমিশন ও নজরদারি
লেবেলসমূহ:
নির্বাচন কমিশন ও নজরদারি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন