সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পুলিশের উদ্বেগজনক পক্ষপাত!

অপরাধ ঠেকানো, অপরাধ ঘটলে অপরাধের যথাযথ তদন্ত করা, অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং বিচারের মুখোমুখি করার কাজগুলো পুলিশ সদস্যদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব। সুতরাং আইন অনুযায়ী তাঁরা ন্যায়নিষ্ঠভাবে সেই দায়িত্ব পালন করবেন—সেটাই প্রত্যাশিত। এখানে কে কোন দলের সদস্য, সেটা মোটেও বিবেচ্য নয়। কিন্তু এই নির্বাচনে একটা ব্যতিক্রম স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে—তফসিল ঘোষণার আগে থেকেই তাঁদের বিভিন্ন কার্যকলাপে আইন লঙ্ঘন এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কৌশলের হাতিয়ার হিসেবে ভূমিকা পালনের যেসব অভিযোগ উঠছিল, সেগুলো বন্ধ হওয়ার বদলে বরং একটি প্রবণতার রূপ নিয়েছে।

প্রথমত, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কৌশল বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বিরোধীদলীয় সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী, মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী, তাঁদের এজেন্ট হতে পারেন—এমন ব্যক্তিদের তালিকা ধরে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। এরপর গত সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কাল্পনিক নাশকতার মামলা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কথিত নাশকতার ঘটনাগুলোর উল্লেখযোগ্যসংখ্যকের ক্ষেত্রে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ওই সব মামলা হয়েছে ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে। মৃত ব্যক্তি, হজে যাওয়া বা বিদেশে অবস্থান করা ব্যক্তি এবং কারাগারে আছেন—এমন নেতা-কর্মীরাও এসব মামলার আসামি। এ ধরনের মামলা একটি-দুটি নয়, শত শত। এ ধরনের মামলাতেই বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হিসাবে ধানের শীষ মার্কার ১৭ জন প্রার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। রাজনৈতিক কারণে পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহারের এ এক নতুন নজির।
দ্বিতীয়ত, গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এসব মামলায় গ্রেপ্তারের যৌক্তিকতা দেখাতে গিয়ে বলা হচ্ছে, অপরাধীকে তো দলীয় পরিচয়ের কারণে ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। মামলা আছে বলেই এঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। সেপ্টেম্বরের পর থেকে করা মামলাগুলোর গায়েবি চরিত্রের কারণে সেগুলোয় গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশের ব্যাখ্যা এখন আর গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কথিত বন্দুকযুদ্ধের গল্পের মতো ভবিষ্যতেও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশের ভাষ্য আর বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তৃতীয়ত, অতীতে সরকারবিরোধী নানা রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক আন্দোলন দমনে পুলিশের বিরুদ্ধে যে ধরনের বাড়াবাড়ির অভিযোগ রয়েছে, অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ বা নিষ্ঠুর আচরণের, নির্বাচনের সময়েও তা অব্যাহত আছে। এটি সামগ্রিকভাবে পুলিশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে। ন্যূনতম শক্তিপ্রয়োগে অপরাধ দমন ও শান্তি রক্ষা করতে পারার ওপরই পুলিশের কৃতিত্ব নির্ভরশীল।
চতুর্থত, ক্ষমতাসীন দলের অপরাধীদের প্রশ্রয় দেওয়ার প্রবণতা নির্বাচনের সময়েও অব্যাহত থাকায় পুলিশের রাজনৈতিক পক্ষপাত প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। টাঙ্গাইলে হত্যা মামলার পলাতক আসামি নির্বাচনী সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন, চট্টগ্রামে অস্ত্রধারীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে বিরোধী প্রার্থীর সভায় হামলা করছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমনকি নারী প্রার্থীদের ওপর হামলার সময় পুলিশের দর্শকের ভূমিকা পালন, বিরোধী প্রার্থীদের অভিযোগ গ্রহণে গড়িমসি, সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে নিষ্ক্রিয়তার মতো ঘটনাগুলোয় পুলিশ যে ন্যায়নিষ্ঠভাবে আইন প্রয়োগ করেছে, সে কথা কেউই বলছে না।
পঞ্চমত, নির্বাচন কমিশনের আদেশ ছাড়াই সরকারের নির্দেশনায় তাঁরা সম্ভাব্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ করেছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছিল, এখন তার সত্যতা মিলছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, সরকার-সমর্থকেরা নির্বাচনী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অন্য যাঁদের আনুগত্য বা আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে ন্যূনতম সংশয় আছে, তাঁরা বাদ পড়েছেন।
সম্প্রতি একদল সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। এসব কর্মকর্তার অধিকাংশই গত ১০ বছরে বিভিন্নসময়ে অবসর নিয়েছেন। অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তারা সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নিতেই পারেন। কিন্তু অবসর কার্যকর হওয়ার আগে পারেন না। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক শহীদুল হকও ওই দলে ছিলেন। তিনি গত জানুয়ারিতে পদ ছেড়েছেন। যার মানে হচ্ছে, তিনি এখনো অবসরপ্রস্তুতিকালীন ছুটিতে (এলপিআরে) আছেন এবং তাঁর অবসরজীবন এখনো শুরু হয়নি। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলেও তিনি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। সম্প্রতি সাতক্ষীরার কলারোয়া থানার ওসির ভোট চাওয়ার ভিডিও নিয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত হওয়ার মতো অপরাধ হলেও তাঁকে শুধু প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব বিষয়কে যদি কেউ পুলিশের দলীয় পক্ষপাতের প্রমাণ হিসেবে দাবি করেন, তা কি নাকচ করে দেওয়া যাবে?
পুলিশ বাহিনীর সবাই নিশ্চয় এ ধরনের অন্যায় পক্ষপাতমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেননি। কিন্তু যাঁরা করছেন, তাঁদের সাময়িক কিংবা ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধার আশায় তাঁরা কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। দেশের বাইরে বৈশ্বিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিক্রিয়া তাঁদের জন্য মোটেও সুখকর হওয়ার কথা নয়। এ রকম ধারণা প্রতিষ্ঠা পেলে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষার কাজে অংশগ্রহণ কিংবা বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার যে আশঙ্কা দেখা দেবে, সেটা কি ঠিক হবে?
( প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত নিবন্ধ। ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...