আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন যে এবারের নির্বাচনে তাঁদের দলের
পক্ষে সত্তরের মতো গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। বিপরীতে এই নির্বাচনে প্রধান
প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেন বলেছেন, তিনি তাঁর ৫০
বছরের বেশি সময়ের রাজনৈতিক জীবনে এ ধরনের নির্বাচন আর কখনো দেখেননি। হিসাবের দিক
থেকে দুই পক্ষের কথাতেই একটা মিল পাওয়া যায়। দেশের ভেতরেও এমন কোনো লোক খুঁজে
পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যাঁরা এ রকম আর কোনো নির্বাচন দেখেছেন।
যেসব কারণে এই নির্বাচন আলাদা, তার তাত্ত্বিক আলোচনা এর আগে অনেকেই করেছেন
এবং এখনো করছেন। শিগগিরই তা শেষ হওয়ার কোনো কারণও নেই। তবে, আমি সেসব তাত্ত্বিক
দিকে জোর না দিয়ে শুধু কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য এখানে তালিকাভুক্ত করতে চাই। কেননা,
এগুলোর প্রভাব মোটেও ক্ষণস্থায়ী নয়, বরং সুদূরপ্রসারী।
১. অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যে দল ও যে নেতার নেতৃত্বে
নব্বইয়ের দশকে প্রায় তিন বছর উত্তাল আন্দোলন হয়েছে এবং দেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থায় জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ধারা চালু হয়েছিল, এবারের নির্বাচন হচ্ছে
সেই নেতা এবং দলের অধীনে। ওই দলের একক সিদ্ধান্তেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক
সরকারব্যবস্থার বিলোপ ঘটে (আদালতের রায়ে অন্তত আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক–ব্যবস্থায়
অনুষ্ঠানের সুযোগ রাখা হলেও তা নাকচ করা হয়)।
২. সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কারণে মন্ত্রী-সাংসদেরা সরকারি
সুবিধার অনেক কিছুই ভোগ করছেন। নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা ছোট করার কথা বলা হলেও তা
হয়নি; বরং সাংসদ নন এমন চারজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী তফসিল ঘোষণার পর পদত্যাগ করা
সত্ত্বেও এক মাসের বেশি স্বপদে বহাল ছিলেন।
৩. অভাবিত এক রাজনৈতিক মেরুকরণে গড়ে ওঠা দুটি প্রতিপক্ষ। এক পক্ষে
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, যারা নিজেদের এত দিন ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল
দাবি করে এলেও সবচেয়ে গোঁড়া ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সমঝোতা করেছে এবং
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করা ব্যক্তিকে দলীয় প্রতীকে
মনোনয়ন দিয়েছে। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতের সঙ্গে প্রায় দুই
দশক জোটবদ্ধ থাকা বিএনপির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ও
ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাসী কয়েকটি দল নতুন করে বৃহত্তর জোট গড়েছে।
৪. নির্বাচনের জন্য সমসুযোগ তৈরির বিষয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের
উপর্যুপরি আশ্বাস সত্ত্বেও দেশের নির্বাচনী ইতিহাসে এটিই হচ্ছে
সবচেয়ে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিক পক্ষপাত এর আগে কখনোই এতটা প্রকট হয়নি।
সবচেয়ে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিক পক্ষপাত এর আগে কখনোই এতটা প্রকট হয়নি।
৫. নির্বাচন কমিশন সরকার এবং ক্ষমতাসীন জোটের সব অন্যায় এবং আচরণবিধি
লঙ্ঘনকে নির্বিবাদে মেনে নিয়ে বৈধতা দেওয়ার পণে অনড় রয়েছে। এলাকা ছেড়ে দেওয়ার
হুমকি এবং ভোটকেন্দ্রে নৌকা প্রতীক ছাড়া কাউকে ভোট দিতে দেওয়া হবে না—মন্ত্রীসহ একাধিক প্রার্থীর
এমন ঘোষণার ভিডিও থাকলেও কমিশন নিষ্ক্রিয় থাকার নীতি নিয়েছে।
৬. তফসিল ঘোষণার পরও পুলিশ এবং প্রশাসনে পদোন্নতি এবং বিভিন্ন ধরনের আর্থিক
সুবিধা ঘোষণা করার নতুন নজির তৈরি হয়েছে।
৭. তফসিল ঘোষণার পরও বিভিন্ন পেশা—যেমন শিক্ষক, সেনা কর্মকর্তা, বিচারকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনামূলক
ব্যবস্থার ঘোষণা।
৮. মাঠপর্যায়ে নির্বাচনী কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশি তদন্তের
মাধ্যমে দলীয় আনুগত্য যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা।
৯. স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান—যেমন পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সংসদ
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়ে যোগ্যতা নির্ধারণে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের
আলোকে নির্দেশনা না দিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের ওপর তা ছেড়ে দেওয়া। যার পরিণতিতে
রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়নপত্র বাতিল হয় এবং কমিশনকে বিপুলসংখ্যক আপিল নিষ্পত্তির দায়িত্ব পালন করতে হয়।
রেকর্ডসংখ্যক মনোনয়নপত্র বাতিল হয় এবং কমিশনকে বিপুলসংখ্যক আপিল নিষ্পত্তির দায়িত্ব পালন করতে হয়।
১০. উচ্চ আদালতের নজিরবিহীন হস্তক্ষেপের ফলে বিরোধী দলের ২৩ জন প্রার্থিতা
হারিয়েছেন এবং কয়েকজন
স্বতন্ত্র প্রার্থীরও (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। নির্বাচন
কমিশন প্রার্থিতা চূড়ান্ত করার পর যেকোনো বিরোধ নির্বাচনের পর নির্বাচনী
ট্রাইব্যুনালে বিচারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত থাকা সত্ত্বেও এই
ব্যতিক্রম বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
১১. হাইকোর্টে মামলা করে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনের
আপিল করার নজিরও এবারই তৈরি হয়েছে। এ রকম সচরাচর ঘটে না। বিপরীতে ঋণখেলাপির কারণে
প্রার্থিতা হারানোর পর ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী উচ্চ আদালত থেকে তাঁর ঈপ্সিত
প্রতিকার পেয়েছেন। সে রকম ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং কমিশন উদ্যোগী বা সক্রিয় ভূমিকা
নেয়নি।
১২. সর্বোচ্চসংখ্যক প্রার্থী (১৭ জন)মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর গ্রেপ্তার।
অধিকাংশ গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেই পুলিশ নাশকতার মামলা থাকার কারণ দেখালেও মনোনয়নপত্র
জমা দেওয়ার আগে সেসব মামলার বিষয় তাঁদের কারোরই জানা ছিল না।
১৩. তফসিল ঘোষণা এবং নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীকে
গ্রেপ্তারের নতুন রেকর্ড হয়েছে এবং এই অভিযান এখনো চলছে। গণমাধ্যমের হিসাব
অনুযায়ী, ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন কয়েক হাজার।
১৪. নির্বাচনী প্রচারে নেমে হামলার শিকার প্রার্থীর সংখ্যাও এবারে
সর্বোচ্চ। তাঁদের মধ্যে নারী প্রার্থীরাও রয়েছেন। এসব প্রার্থী প্রধানত ক্ষমতাসীন
দলের সমর্থকদের আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এমনকি নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে আওয়ামী লীগের জোটভুক্ত জাতীয় পার্টির এক
প্রার্থী বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে নির্বাচনী প্রচারণায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। কয়েকটি
ক্ষেত্রে, যেমন নোয়াখালীতে মাহবুব উদ্দিন খোকন এবং সিরাজগঞ্জে রুমানা মাহমুদ
পুলিশের হামলায় আহত হয়েছেন। প্রার্থীদের পরিবারও রেহাই পাচ্ছে না।
১৫. প্রাক্-নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানির সংখ্যা এখনো কম থাকলেও সহিংসতার
বিস্তৃতি অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে। অতীতে জাতীয় নির্বাচনে সহিংসতার
সিংহভাগই ঘটেছে ফল প্রকাশের পর এবং ভোটের দিনে।
১৬. এবারই প্রথম জাতীয় নির্বাচনে সরকারি রেডিও-টিভিতে প্রতিদ্বন্দ্বী সব
পক্ষকে সমান সুযোগ দেওয়ার নীতিতে ব্যত্যয় ঘটেছে। খবরেও যেমন বিরোধীরা ভারসাম্যমূলক
প্রচার পাননি, তেমনি জাতির উদ্দেশে তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার কোনো সুযোগ দেওয়া
হয়নি। আর বেসরকারি রেডিও এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠই রাজনৈতিক
বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়ায় সেগুলোতে বিরোধীদের জন্য তেমন একটা সুযোগ ছিল না।
১৭. এবারই প্রথম বড় ধরনের কোনো জনসভার আয়োজন ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠিত
হচ্ছে। তাতে এ ধরনের সমাবেশে জনসাধারণের উপস্থিতি প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি
জনসাধারণের সমর্থনের ইঙ্গিতবাহী হিসেবে বিবেচিত হতো। প্রকৃতপক্ষে, এবারে নির্বাচনী
প্রচার আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার পর বিরোধী দলগুলোকে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে কোথাও
বড় ধরনের সমাবেশ অনুষ্ঠানের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বিপরীতে, ক্ষমতাসীন জোট
কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সমাবেশ না করলেও ঢাকায় ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় জনসভা
করেছে।
১৮. অভূতপূর্ব একতরফা নির্বাচনী প্রচার দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি
মাইলফলক হয়ে থাকবে। নির্বাচনের বছরখানেকের বেশি সময় আগে থেকে ক্ষমতাসীন দলের নৌকা
প্রতীক এবং প্রার্থীদের অনেকেই রঙিন পোস্টার-ফেস্টুন-ব্যানার ব্যবহার এবং তোরণ
নির্মাণের পর আনুষ্ঠানিক প্রচারেও একচেটিয়া প্রাধান্য বজায় রেখেছেন। বিপরীতে
বিরোধীরা না পেরেছেন পোস্টার লাগাতে, না পেরেছেন স্বল্পসংখ্যায় যতটা লাগাতে
পেরেছেন, সেগুলো রক্ষা করতে।
১৯. প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়কে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন
দেওয়ার এক নতুন নজির তৈরি হয়েছে এই নির্বাচনে।
২০. এবারই প্রথম সবচেয়ে কমসংখ্যক দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন
পর্যবেক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সর্বশেষ যে প্রকৃত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ
নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল, সেই নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ভোটকেন্দ্রপ্রতি অন্তত পাঁচজন
করে পর্যবেক্ষক ছিলেন। আর এবারে মোট ভোটকেন্দ্রের তিন ভাগের দুই ভাগেই কোনো
পর্যবেক্ষক থাকার সম্ভাবনা থাকছে না। ৮০ হাজার কেন্দ্রের জন্য মাত্র ১৫ হাজার
পর্যবেক্ষক এবার নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি পেয়েছেন।
তালিকাটিকে অসম্পূর্ণ বললে যে খুব একটা ভুল হবে, তা নয়। প্রধান বিরোধী জোট
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং বাম জোট উভয়েই বলেছে যে ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪–এর মতো আরও একটি বিনা
প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। তাঁদের অভিযোগ, নির্বাচনী
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অন্যদের জন্য বাধা সৃষ্টির লক্ষ্যই ছিল তাই। কিন্তু তাঁরা এবার
সেই সুযোগ দেবেন না বলেই সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ভোটের লড়াইয়ে থাকবেন।
তাঁদের আশা, গত ১০ বছরের শাসনকালে নানা কারণে ক্ষুব্ধ বিপুলসংখ্যক মানুষ ভোট দিতে
এলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। সে কারণেই তাঁরা এখন অভিযোগ করছেন, বিরোধীদের ওপর হামলা,
গায়েবি মামলা ও গণহারে ধরপাকড়ের মাধ্যমে একটা ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা করছে
সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল।
রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণে নির্বাচন যতটা অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে, তাতে
স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ঘাটতি যে রয়েই গেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে,
ভোটারদের জন্য এটি অংশগ্রহণমূলক হবে তো? দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও
অবাধ নির্বাচন অসম্ভব প্রমাণিত হলে বিরোধীরা লাভবান হবে, তাদের দাবির যৌক্তিকতা
প্রমাণিত হবে। কিন্তু সরকার জবরদস্তি ছাড়া কি দেশ পরিচালনায় সক্ষম হবে?
( ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৮‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন