সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সম্পাদকীয় স্বাধীনতার লড়াই না অন্য কিছু ?


সম্প্রতি সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষা এবং সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষ বাড়ানোর লক্ষ্যে এডিটরস গিল্ড, বাংলাদেশ নামে একটি নতুন সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও  সাংবাদিকতার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে যেকোনো উদ্যোগকেই সবার স্বাগত জানানো উচিত। সুতরাং, নতুন উদ্যোগকে শুভেচ্ছা।  তবে, এখানে কিছু জরুরি প্রশ্নের কথা বলে রাখা দরকার যেগুলোর কোনো সন্তোষজনক জবাব আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
প্রশ্নগুলো যাঁরা এই উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁদেরকে ঘিরে। এঁদের প্রায় সবাই গত দশ বছরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং গণমাধ্যমবিরোধী সব সরকারী নীতি ও পদক্ষেপকে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে সমর্থন ও ইন্ধন দিয়ে এসেছেন। এঁরা কিভাবে স্বাধীন সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান গড়ায় ভূমিকা রাখবেন? নতুন গড়ে তোলা সংগঠনের প্রধান এর আগে একাধিকবার প্রকাশ্য বক্তৃতা ও লেখায় গণমাধ্যমের ওপর নানাধরণের নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। যে কেউ গণমাধ্যমের মালিক হোক এমন সুযোগের তিনি ঘোরবিরোধী। যার মানে দাঁড়ায় বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাধরদের অনুগ্রহ ও কৃপালাভকারী যেসব সুবিধাভোগী অতীতে টিভি-রেডিও-পত্রিকা-অনলাইন পোর্টালের অনুমোদন পেয়েছেন, তাঁদের বাইরে আর কেউ যেন ঐ জগতে ঢুকতে না পারে। প্রতিযোগিতাকে তাঁদের বড্ড ভয়। স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেউ এই ভালোই তো আছি গোছের আবহ সৃষ্টির বৃত্ত ভাঙ্গুক সেটা তাঁরা চান না। অথচ, পাঠক-দর্শক-শ্রোতা কথিত উন্নয়ন সাংবাদিকতার বিরক্তিকর জাবরকাটা থেকে পরিত্রাণ পেলে স্বস্তির নি: শ্বাস ছাড়তে পারবে। বৃত্তবন্দী অবস্থায় আর যাই হোক মুক্ত সাংবাদিকতার বিকাশ ঘটে না।

আমরা জানি, দেরিতে হলেও স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে অতিসম্প্রতি সম্পাদক পরিষদ একটা জোরালো অবস্থান নিয়েছে। প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের কুখ্যাত ৫৭ ধারার যথেচ্ছ ব্যবহার এবং পরে  নিবর্তনমূলক ডিজিটাল আইন তৈরিই সম্পাদক পরিষদের এই প্রতিবাদী হয়ে ওঠার মূল কারণ। নতুন সংগঠন জন্ম দেওয়ার সময়ে উদ্যোক্তারা বলেছেন ‘‘ বাংলাদেশে সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সংগঠন থাকলেও সেগুলো সব ধরনের গণমাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারেনি। সেদিক থেকে এডিটরস গিল্ডই দেশের প্রথম সংগঠন যেখানে সব ধরনের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত থাকছে বলে এর উদ্যোক্তাদের ভাষ্য। তাঁদের এই বক্তব্যে নিজেদেরকে সম্পাদক পরিষদের বিকল্প হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টাই কি প্রকটভাবে ধরা পড়ে না? সম্পাদক পরিষদের মত প্রতিষ্ঠানকে খাটো করার এই চেষ্টায় কেন জানি রাজনীতির একটা গন্ধ পাওয়া যায়।
এখানে আবারও স্মরণ করা যায় নবজন্ম নেওয়া সংগঠনটির প্রধান মাত্র তিনবছর আগে ২০১৫ সালে সম্পাদক পরিষদের সরাসরি বিরোধীতা করে Why I do not agree with Editors Council শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন। তখন সম্পাদক পরিষদ গণমাধ্যমের ওপর সরকারের নানাধরণের হুমকি, নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা এবং সংবাদকর্মীদের ওপর ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের হামলার বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো। ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোয় বেসরকারী বিজ্ঞাপন প্রকাশে বাধাদান, ঐ দুই পত্রিকার সম্পাদকদ্বয়ের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দায়ের এবং নিউ এজ পত্রিকায় পুলিশী অভিযানের পটভূমিতে সম্পাদক পরিষদ ঐ বিবৃতি দিয়েছিল।

সংবাদ প্রকাশনা শিল্পে যারা সম্পাদকীয় নেতৃত্ব দেন তাদের সংগঠন হিসাবে এর মূল কাজ হবে একটা কোড অব এথিকস অর্থাৎ নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি বলেও তাঁরা জানিয়েছেন। এই সংগঠনের উদ্যোক্তারা বিগত তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই না করে প্রকাশ করার জন্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সমালোচনা করলেও গত কয়েকবছর ধরে তাঁরা নিজেরাই একই কাজ করে চলেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার গোপনে ধারণ করা সরকারবিরোধী রাজনীতিকদের কথিত টেলিফোন সংলাপের সত্যাসত্য যাচাই না করেই তাঁরা সেগুলো দিনের পর দিন প্রকাশ ও  প্রচার করে চলেছেন। এঁরা যদি নিজেদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটু একটু করে নৈতিকতার নীতি অনুসরণ শুরু করতে পারতেন তাহলে তাতে বরং দেশ-জাতি আরও বেশি উপকৃত হতো।

আপনি আচরি ধর্ম শিখাও অপরে নীতি যেখানে অনুপস্থিত সেখানে রাজনীতি কিম্বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকাটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কী?

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...